শ্রাবণসংক্রান্তিতে বেহুলার লাচারি

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

‘চাঁদ সওদাগরের জেদ ছিল, মনসার পূজা সে কিছুতেই করবে না। কিন্তু মনসা দেবীর পূজা তাকে দিতেই হয়েছিল।’ বললেন লুবনা মারিয়াম। মাইক্রোবাসের চালককে বললেন, ‘নাসির, এসিটা বন্ধ করে দাও।’ মাইক্রোবাস চলছে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের উদ্দেশে। সেখানে পাঁচ অভিযাত্রী যোগ দেবেন বেহুলার লাচারিতে। শ্রাবণসংক্রান্তির এই উৎসবযাত্রা শুরু হবে এলেঙ্গা গ্রামের এলংজানী নদী থেকে; ধলেশ্বরীর শাখা নদী এটি।

গতকাল মঙ্গলবার ভোরে এই উৎসবে যোগ দিতে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে একটি দল। দলে আছেন সাংস্কৃতিক সংগঠন সাধনার প্রতিষ্ঠাতা ও আর্টিস্টিক ডিরেক্টর লুবনা মারিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও নাট্যজন সৈয়দ জামিল আহমেদ, যাত্রীকের আগাখানী যুবক নওশাদ অবলী হুসেইন, তরুণ প্রকৌশলী সোহেল রানা। সাধনা আর যাত্রীক মিলেই এ যাত্রার আয়োজন করেছে। এলেঙ্গা বাজার থেকে এ দলে যোগ দেবেন ফোকলোর বিশেষজ্ঞ শফিউদ্দিন তালুকদার। শমসের ফকির ডিগ্রি কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি পড়ান তিনি। দীর্ঘদিন ধরে এই গবেষক কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আছেন ভূঞাপুর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম।

যাত্রাপথে গাজীপুর চন্দ্রার কাছে সামান্য যানজট। বস্ত্রবালিকারা সড়ক প্রদক্ষিণ করছেন। একটি জাতিকে বসনাবৃত্ত করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন যাঁরা, তাঁদের যাওয়ার জন্য একটু অপেক্ষা করতেই হয়।

শফিউদ্দিনের আয়োজন ও সহায়তায় শ্রাবণসংক্রান্তির উৎসবে যোগ দিতে যাত্রা শুরুর আড়াই ঘণ্টার মাথায় মাইক্রোবাস থামে নদীর ঘাটে। ততক্ষণে সেখানে প্রস্তুত উৎসবের নৌকা। তাতে মনসা বা পদ্মা দেবীর জন্য প্রসাদ প্রস্তুত করছেন কয়েকজন মুসলিম ও সনাতন ধর্মের নারী-পুরুষ। সারা বাংলাতেই এই উৎসবে যোগ দেয় সব ধর্মের মানুষ। মুসলমানরাও মানত করে সাধ্যমতো টাকা দিচ্ছে, নিয়ত করে লখিন্দরের প্রতীকী ভেলায় বেঁধে দিচ্ছে এক টুকরা রশি। ভেলার ওপরে লাল সালু, কাপড়ের ফুল ও জরি দিয়ে মোড়ানো। মনসা দেবীর প্রসাদের পাত্রে রয়েছে সেদ্ধ ডিম, দুধ, কলা, আনারস, আম। ডিমের ওপর সিঁদুর দিয়ে দুটি ফোঁটা এঁকে দেওয়া হয়, পাশেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আগরবাতি।

বন্দনাগীতের মধ্য দিয়ে আচার শুরু হয়। এই উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য এ রকম সজ্জিত, মাইক ও বাদ্যযন্ত্রসমেত নৌকা বেরিয়েছে অনেকগুলো। তবে বেশির ভাগই বের হয়েছে কালিহাতী, গোপালপুর, ভূঞাপুর, ঘাটাইল, সখীপুর ও বাসাইল থেকে। আর এসব নৌকায় আছে বিশেষ পোশাকে সজ্জিত বেহুলা, লখিন্দর, পদ্মা, দাসী, সনকা (চাঁদ সওদাগরের স্ত্রী) ও ঘটক। একটি পোশাক পরিহিত বাঘও রয়েছে সঙ্গে।

সব দলের সঙ্গে যাওয়া হয় না। মনিরের নৌকার পিছু নেয় অভিযাত্রী দলটি। মনির মাইকে ঘোষণা দেন, নৌকায় খারাপ আচরণ করা যাবে না। ওঝা মনির উপবাস ছিলেন সারা দিন। সাত ঘাট ঘুরে তাঁর দল গান করবে আর পূজা দেবে মনসা দেবীর। দলের প্রধান মনির চাকরি করেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গাঁয়ের লোকের সেবা করতে তিনি ওঝার কাজ করেন।

মনিরের নৌকা একের পর এক ঘাটে যায়, প্রসাদ ভাসিয়ে দেয়, গান করে। মনসা দেবীর বদলে ঘাটসংলগ্ন গাঁয়ের উলঙ্গ শিশুরা সেসব কুড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ কাজে ভীষণ আনন্দ তাদের।

সব শেষে নৌকা গিয়ে পৌঁছায় আদাজান গ্রামের করিমের বাড়িতে। করিম তিন দিন রোজা ছিলেন। তাঁর বাড়িতেই লখিন্দরকে জিয়ানো হবে। এ এক টুকরা নাট্যাংশ। আশপাশের গ্রাম থেকে এটি দেখতে ভিড় জমে যায়। পুরাণের লোহার বাসরে সাপ ঢুকবে, দংশন করবে লখিন্দরকে। পদ্মা দেবীর কাছ থেকে বর নেবে বেহুলা। স্বামীকে বাঁচাতে সবার কাছ থেকে ভিক্ষা করে দেবীর পূজা দিতে হবে। যে ভিক্ষা না দেবে, নির্বংশ হবে সে। উপস্থিত সবাই লখিন্দরকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। সৈয়দ জামিল আহমেদ পকেট থেকে বের করে দেন ১০০ টাকা। দেওয়া হয় পূজা, বেঁচে ওঠে লখিন্দর।

অবশেষে আসে বেহুলার ফিরে যাওয়ার পালা। ঝিনুক নদে ভেলা ভাসিয়ে চোখের জলে বুক ভাসায় মনিরের নৌকার নারী-পুরুষেরা। বিদায়ের কালে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। অর্থাৎ, যাওয়ার বেলায় কোনো রাগ রাখা যাবে না। গান গাইতে গাইতে নদের ওপর দিয়ে ছুটতে থাকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। মনসার পূজা বুঝি কবুল হয়, মুষলধারে বৃষ্টি নামে নদে।

লুবনা মারিয়াম জানান, সেপ্টেম্বরের ৪ ও ৫ তারিখ ভূঞাপুরে বেহুলার লাচারির শিল্পীদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। এতে অংশ নেবে প্রায় ১০টি দল। নাচের নতুন চলন খুঁজতে তাঁর এই অনুসন্ধান। সারা দিনের ক্লান্তি তাঁকে বসে থাকতে দেয় না। তিনি নৌকাতেই গা এলিয়ে ঘুমে হারিয়ে যান।

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

আরও লেখা

আলো ভাগাভাগি করে বাঁচি

যে কোন পরামর্শ, সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করুন