মাঝনদীতে এসে মাঝি জানতে চাননি, সাঁতার জানি কি না । জানতে চান, দুপুরে তাঁর বাড়িতে মেহমান হব কি না। তার আগে অবশ্য আমরাই গ্রামে ভাতের হোটেলের খোঁজ করেছিলাম। কাঁঠালিয়া নদীর দুই পাশেই গ্রাম। কিন্তু কোনো ভাতের হোটেল নেই। গ্রামে ভাতের হোটেল থাকবেই বা কেন! বেশির ভাগই তো গৃহস্থ। কাঁঠালিয়ার মাঝি মো. লোকমান বগলের নিচে বইঠা আটকে লুঙ্গির গিঁটের ভেতর থেকে বের করে আনেন একটি সাধারণ ফোন। সেটি কানে লাগিয়ে ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে স্ত্রীকে বলেন, ‘দুজন মেহমান খাইব।’ আমরা ইশারায় তাঁকে জানাই, আরেক দিন।
১৯৯৬ সালে লোকমানের বয়স মাত্র ২০, আনসার বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। রোজগারের পথটা বের হওয়ার চার বছর পর বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় সন্তান শান্তার বয়স ১০, পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। রাব্বি নামে ১৫ বছরের একটি ছেলে থাকলেও লোকমানের স্ত্রীকে শান্তার মা নামেই ডাকা হয়। রাব্বি আগে মাদ্রাসায় পড়ত, এখন আর পড়ে না। লোকমানের আরও একটি ছেলে আছে ১৬ মাসের। তার নাম দেওয়া হয়নি এখনো। বিয়ের পরই লোকমানের কপাল খুলে যায়। আসে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ। আনসার লোকমান ছিলেন পাকা কুস্তিগির। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কায় সাফ গেমসে রেসলিং করতে যান তিনি। এর কিছুদিন পর কুস্তি খেলতে পাকিস্তান ও ভারতে যান। রোজগার বাড়ানোর আশায় পরের বছরই পাড়ি দেন সৌদি আরব। বৈধ হতে না পারলেও টানা ছয় বছর ঝালাইয়ের কাজ করতে করতে একসময় আশাহত হয়ে পড়েন। ২০১৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। সাফ গেমসের কুস্তিগির লোকমান এখন কাঠালিয়া নদীর মাঝি। নদীর পারে চেঙ্গাকান্দি গ্রামে তাঁর বাড়ি। সারা দিন নৌকা চালালে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা থাকে।
গোমতী ও মেঘনার কন্যা কাঠালিয়া। দাউদকান্দি উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে মিশেছে তিতাস উপজেলার গোমতীর সঙ্গে। ঢাকা থেকে দাউদকান্দির আড়াই ঘণ্টার পথ। ঢাকা থেকে আমরা দুজন চলে যাই দাউদকান্দি ঘাটে। যেখানে মুখে মুখ ঘষছে অনেকগুলো কেরায়া নৌকা। কোনোটার ছই আছে, কোনোটার নেই। তবে প্রায় সবগুলোর পেটের ভেতর বসানো ডিজেল ইঞ্জিন। মাঝির দাঁড় বাওয়ার দিন বুঝি ফুরিয়েছে।
বেলা তখন গড়িয়ে গেছে। দাউদকান্দি থেকে বাজার করে ঘরে ফিরছে গ্রামের মানুষ। বাজারে জসিমের চায়ের দোকান থেকে গরুর দুধের চা খেয়ে আমরা উঠে পড়ি লোকমানের নৌকায়। যতক্ষণ মন চায় নদীতে ঘোরার ইচ্ছে আমাদের। এ অনেকটা জলে লং ড্রাইভ। কিছু দূর এগোলেই বাঁশ দিয়ে ঘের দেওয়া মাছ ধরার ফাঁদ। পুরো শীতজুড়েই এভাবে মাছ ধরা চলবে।
আলীপুর ঘাটে যাত্রাবিরতি দিই। চা পান করি, ছবি তুলি। চায়ের দোকানে আড্ডারত গ্রামবাসীর সঙ্গে গল্প করতে থাকি। হাঁটু পর্যন্ত তোলা লুঙ্গি নামিয়ে একজন দিনমজুর গোছের মানুষ অনুরোধ করেন যেন তাঁরও একটি ছবি তুলি। সেখানকার প্রায় সবাই লোকমান মাঝির চেনা। চেঙ্গাকান্দি ও এর আশপাশের মানুষেরা নানা কাজ করে। মাছ ধরে, খেত করে।
কোমল পানীয়ের সবুজ পুরোনো একটা বোতলে ৭৫ টাকায় এক লিটার ডিজেল কিনে আনেন লোকমান। তেল নেওয়া শেষে আমরা আবার নৌকায় চড়ি। আলীপুর বাজার হয়ে যাই ভূঁইয়া বাজার। ঘাটে ঘাটে দেখা যায় ঝাঁক বেঁধে গোসল করছে ধবধবে সাদা হাঁস, কালো নারী। হঠাৎ ভুস করে মুখ তুলে পালিয়ে যায় একটি ইরাবতী ডলফিন। এ নদীতে ডলফিন আসার কথা নয়! নিশ্চয়ই পথ ভুল করে এসে পড়েছে।
দাউদকান্দি ঘাটে ফেরার পথে লোকমান কী যেন একটা গান ধরেন, ইঞ্জিনের শব্দে সেই গান বোঝা যায় না। দেশের নৌকাগুলো সরব হয়ে উঠলেও মাঝিরা নীরব হননি, এখনো গান গেয়ে নৌকা চালান। সেটাও মন্দ কী? আমাদের নৌকা ঠিক করে দিয়েছিলেন লোকমানের স্কুলবন্ধু চিত্রকর লিটন। লোকমানের বাড়িতে যেতে চেয়েও যাইনি শুনে ফেরার পথে তিনি বলছিলেন, ‘অয় খাওয়াইন্না বংশের পোলা। বাড়িত গেলে দেখতেন।’ আমরা একবার তাঁর স্ত্রীর হাতের রান্না খেতে যাব, কথা দিয়েছি।