চাকরিচ্যুত অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য …

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

আমি শোষিতের দিকে নজর ফেরাতে চাই। শোষিতের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে কম যারা, তাদের জন্য আমার প্রাণ কেঁদে ওঠে। আজ স্কুলের এক জোড়া জুতো দেখে আমার প্রাণ কেঁদে উঠেছিল। কেন! সেটি না-হয় পরে বলি। আগে বলি গ্রামীন ফোন নামক বিরাট এক লাভজনক প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাটাইয়ের বেদনাহত গল্প।

আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সঙ্কট যেন চাকরি। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেই হাহাকার পরে যায় একটা চাকরির জন্য। আমার বন্ধুদের দেখতাম ব্যাট বা জিপি’র অফিসের সামনে থেকে যখন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িগুলো যেত, তখন তারা লালায়িত চোখে ঈশ্বরকে স্মরণ করতো, যেন তারা এ প্রতিষ্ঠানের কোন একটিতে ঢুকতে পারে। বিশেষত বিবিএ পড়া ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্নই যেন মোবাইল কোম্পানি। স্বপ্ন হলো সত্যি, ইটের পরে ইট। ইট ইজ অ্যা চাকরি। যদিও বিবিএ-এর সিলেবাস চাকরি করার কথা খুব একটা বলে না, বলে উদ্যোক্তা হতে। বিবিএ গ্রাজুয়েট বন্ধুদের দেখে আমার ইটভাঙা মেশিনের কথা মনে পড়ে যায়। কত মানুষ হাত দিয়ে ইট ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করে। যখন ইট ভাঙা মেশিন আসে – বহু শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ে। শ্রমঘন্টা এবং টাকা দুটোই বাঁচানো যায় যন্ত্রের সাহায্যে কাজ করলে। আমার বন্ধুরা বুঝে উঠতে পারছে না যে তারা ঐ হাতে ইটভাঙা শ্রমিকদের দলের। যেখানে সফটওয়্যার সব কাজ করতে সক্ষম সেখানে একজন এক্সিকিউটিভ কেন রাখবে কোম্পানি! মোবাইল কোম্পানি শুরু করে দিয়েছে, এরপর লাইনে আছে ব্যাংক।

কিন্তু চাকরির যে বয়সে এসে চাকরি হারাচ্ছেন এসব ফ্যন্সি জবধারী কর্মীরা সে বয়সে অন্য কোন ধরণের পেশা শুরু করা নেক্সট টু অসম্ভব। অনেকেই দোকান শুরু করে দিয়েছেন।

বাজারের যে পরিস্থিতি, সংসার চালাতে গেলে শুধুমাত্র স্বামীর রোজগারে সংসার চালানো কঠিন। প্রতিদিন দাম বাড়ছে প্রতিটি জিনিশের, শিশুদের পণ্য, খাদ্যের দাম বাড়ছে ঘন্টায় ঘন্টায়। এ অবস্থায় শিশুর মা’কেও নামতে হচ্ছে রোজগারে। এই বদ্ধ সমাজে একজন কর্মী যখন কাজ করতে আসেন তখন তিনি কর্মী থাকেন না। তাকে লিঙ্গের ফিতায় মাপ করা হয়। ফ্যান্সী জবে তো কথাই নেই। মোবাইল ফোন অপারেটরের নারী কর্মীদের গ্লামার তাই তাদের চাকরিপ্রাপ্তি, পদোন্নতির জন্য আবশ্যক। পদোন্নতির জন্য অবশ্য আরও একটু বেশি ছাড় দিতে হয়, পদ (পা) এর উন্নতির জন্য অবনত করতে হয় মাথা।

গ্রামীন ফোন অনেক বড় একটি প্রতিষ্ঠান। তারা বাঙালির ইমোশনকে পুঁজি করেছে। নানা বিজ্ঞাপনে মানুষের ইমোশন বিক্রি করে দিয়েছে মানুষের কাছে। তরুণদের পড়ালেখার আর ঘুমের রাতগুলো কেড়ে নিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে ক্লাসের সময়গুলি, একটা প্রজন্মকে বানিয়ে দিয়েছে ডিজুস প্রজন্ম, আরেকটি প্রজন্মকে বানিয়ে ছেড়েছে নৈতিক প্রতিবন্ধী। মানুষের ইমোশন এদের মতো ভাল আর কেউ বোঝে না। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি যখন একসঙ্গে ২১৭ জন কর্মীকে চাকরিচ্যূত করে তখন বুকের ভেতরে চিন চিন করে ওঠে। যখন সংবাদ হয় যে ওদের মধ্যে ৩ জন নারী মা হতে যাচ্ছে।

একজন নারীর মা হওয়ার সময়টা খুবই স্পর্শকাতর। সৃষ্টির উৎস হয়ে যে নারী অপেক্ষা করে থাকে যে, ঈশ্বরের দূত আসছে! চাকরি হারানো ব্যাথা বেদনায় এ অন্তঃসত্তা মেয়েরা যে মানসিক আঘাত পাবে এর দায় ঐ মুনাফালোভী কোম্পানির। ব্যবসায়িক মূল্যবোধের চর্চা ব্যবসার অংশ কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের চর্চাতো স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জন্মগত। আর্থিক নিরাপত্তা হারানো ওই মায়েরা যদি এতটাই অপ্রয়োজনীয় তবে আরও আগে কেন তাদের জানিয়ে দেওয়া হল না, যে তাদের আর প্রয়োজন নেই! এই হলো নৈতিকতা। গ্রামীন ফোনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে বাংলাদেশী যারা ছিলেন, তারাও চুপ করে গেছেন। আমরা শেষ পর্যন্ত আর মানুষ হতে পারলাম না। ধ্বংস করে দিচ্ছি পরবর্তী প্রজন্মের তরুণদের।

জুতোর গল্পটা হচ্ছে – স্কুল পড়ুয়া মেয়েরা এক সময় স্কুল পালিয়ে প্রেম করতো পার্কের বেঞ্চে। তখন তাদের হাতে মোবাইল ফোন ছিল না।

এখন তারা অনেক গতিশীল। মোবাইল ফোনের দৌলতে তারা যেনে যায়, তার প্রেমিকের কোন বন্ধুর মা আজ বাড়ি থাকবে না। ঘর থাকবে সম্পূর্ণ ফাঁকা। আজ অফিসে যাওয়া পথে দেখি পাশের ঘরের দরজা বন্ধ। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে একটা বালিকাকন্ঠের মৃদ্যু আওয়াজ। মূল দরজায় গিয়ে একজোড়া শাদা জুতো দেখে বুঝলাম, বালিকাটি আইডিয়াল গার্লসের না হলেও স্কুল পড়ুয়া এবং স্কুল পলাতক। আমার কেন যেন চোখ ভিজে এলো। আমাদের যা কিছু পরিশ্রম, কষ্ট, বিপ্লবের স্বপ্ন সব ওদের জন্য। কিন্তু ওরা যে পরিমিতি বুঝতে চায় না। আসলে পরিমিতি বোধ যে আমাদের কারোরই নেই!

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

আরও লেখা

ভেনিসে সেরা হল যারা

শেষ হল এ বছরের ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। গত ৩১ আগস্ট শুরু হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো এ চলচ্চিত্র উৎসব। ৭৯তম এ উৎসবের

বিস্তারিত...

আলো ভাগাভাগি করে বাঁচি

যে কোন পরামর্শ, সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করুন