ঘুম মাখানো চোখে লঞ্চের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, ভোর হচ্ছে। পুব দিকের কালো আকাশে আলোর রেখা। ময়লাটে ব্ল্যাকবোর্ডে যেন চক দিয়ে সরলরেখা টেনেছে কেউ। একটু বেঁকে গেছে। নিচে আকাশের থেকে কালো জলস্রোত। পানির নিচে লঞ্চের প্রপেলার সেই কালো জলকে স্যালাইন বানানোর মতো ঘুটছে। লঞ্চের সামনের গিয়ে মনে হলো, একটা বাড়ির উঠোনে এসে থেমেছে অতিকায় এক নৌকা।
কবি আসাদ চৌধুরীর জন্য অপেক্ষা। তিনি কেবিন থেকে বেরুলে আমরা একসঙ্গে ঘাটে নামব। অন্যেরা নিজে নামছে, হাতে হাতে সবার মালামাল নামাচ্ছে। যেতে হবে ইসলামপুর গাছতলা গ্রামে। এই সফর বা গ্রামটা সম্পর্কে কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি আমাকে। শুধু বলা হয়েছে, আড্ডা দেওয়া এবং ইলিশ খাওয়া। অন্যরা কম বেশি জানেন। শুনেছি এই আড্ডায় যাওয়ার জন্য নাকি রীতিমতো অনুরোধে জর্জরিত হয়ে যান ভ্রমণ লেখক গাজী মুনছুর আজিজ।
চাঁদপুর নাকি ইলিশের জন্য বিখ্যাত। সফরকারীদের ইলিশের বেশ কয়েকটি রেসিপি খাওয়ানো হবে। এ জন্য আড্ডার নাম ‘ইলিশ আড্ডা’। এতে যোগ দিতে আমার প্রথমবার চাঁদপুর যাওয়া। শুনেছি এর আগে অনেক কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এখানে এসেছেন। প্রতি বছর ঘটা করে একটা ছোট খাট দল নিয়ে আজিজ এখানে আসেন। এবার দলে আছেন কবি আসাদ চৌধুরী, বিবিসির সাংবাদিক সায়েদুল ইসলাম তালাত, দৈনিক সকালের খবরের নিজস্ব প্রতিবেদক নুরুজ্জামান লাবু ও বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এস এম মিজান।
গত ৭ অক্টোবর রাতে ঢাকার সদরঘাট থেকে এমভি রফ রফ নামের একটি লঞ্চে চড়ি আমরা। বারবার বলে দেওয়া হয়েছে, লঞ্চ ছাড়বে রাত ১০টায়। তাড়াহুড়া করে পৌঁছে জানা গেল, লঞ্চ আসলে ছাড়বে রাত সাড়ে ১১টায়। আয়োজক আজিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বেশির ভাগ লোক দেরি করে আসেন। সে জন্যই এই দুষ্টুবুদ্ধি। খারাপ লাগে না আমার। লঞ্চটা সুন্দর। লঞ্চে উঠে কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে গল্প শুরু করি আমরা। তিনি গল্পের বাক্স। গল্প, তথ্য কোনোটিরই অভাব নেই তাঁর ঝোলায়। সত্তুরোর্ধ আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের ক্লাসে। প্রথম দিন ক্লাস শুরুর আগে ঝোলার ভেতর থেকে একের পর এক এটা–ওটা বের করতে থাকেন তিনি। বেরোল টুপি, বেরোল জর্দার কৌটা, বই, পান …। আমি অবাক হই, এত প্রগতিশীল মানুষের ঝোলার ভেতর টুপি!
সফরের দিনে আসাদ ভাইয়ের শরীর একটু খারাপ। নিজের কেবিনে খালি গায়ে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলেন। আমরা সেখানে ঢোকার পর উঠে আধশোয়া হন। জোর করে শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। তরুণদের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে আড্ডা দিতে চাইলেন না তিনি। শরীর যখন আর সায় দিচ্ছিল না, তখন একটু একা বিশ্রামে চলে যান। আমরা দল বেঁধে লঞ্চের নানা জায়গায় আড্ডা শুরু করি। দফায় দফায় আড্ডা। মাঝেমধ্যে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক। লঞ্চ বুড়িগঙ্গা হয়ে মেঘনা পাড়ি দিয়ে ভোরে এসে ভেড়ে ডাকাতিয়া নদীর ইচলী ঘাটে।
লঞ্চ থেকে নেমে অটোরিকশায় আমরা পৌঁছাই গাছতলা গ্রামের খেয়াঘাটে বোরহান দেওয়ানের বাড়িতে। এটা আজিজের বোনের বাড়ি। ব্যাগ রেখে কেউ বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, কেউ ছুটে যায় ডাকাতিয়ার পাড়ে। তখন আকাশ আলোকিত। সূর্য ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই একসঙ্গে ঘুম!
আড্ডা হলো শুরু
সকাল ১০টার দিকে সবাইকে টেনে হিঁচড়ে ঘুম থেকে তোলা হলো। নাশতা করতে যেতে হবে খেয়াঘাটে। বোরহান দেওয়ানের হোটেলে কড়া করে ভাজা পরোটা, ডাল আর ডিমভাজা। একটা চৌকির ওপর শীতলপাটির পেতে সবাই খেলাম। নদীর হাওয়ায় রাক্ষসের ক্ষুধা জমে ছিল পেটে। দেওয়ান সাহেব ও তাঁর কর্মীরা পরোটা বানাতেই থাকলেন, বানাতেই থাকলেন।
আড্ডা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। প্রতিবেদক লাবু ভাইয়ের হাতে ক্যামেরা। ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে বটতলায় তালাত ভাইকে নানা ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে লাবু ভাই ক্যামেরা ক্লিক করেই চলেছেন। ছবিগুলো ভালো হচ্ছিল না। কিন্তু ক্যামেরার ব্যাটারির মুমূর্ষু অবস্থা।
তবু একটা আনুষ্ঠানিকতা করা হলো। কার বাড়ি থেকে ধরে আনা হলো পায়রা। সবাই মিলে সেগুলো উড়িয়ে শুরু হলো আড্ডা। আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা দিলেন আসাদ ভাই। বললেন, জাতীয় মাছ ইলিশের রাজধানী খ্যাত চাঁদপুরের এ ইলিশ আড্ডা ইলিশের ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। তাঁর আশা, ইলিশ কেন্দ্রিক এ ব্যতিক্রমী আড্ডা সৃজনশীল আড্ডার এক নতুন গন্তব্য হবে।
আজিজের আনুষ্ঠানিকতার সীমা থাকে না। বাধানো একটা সাদা ক্যানভাস টেনে বের করেন তিনি। তাতে মন্তব্য লিখতে শুরু করেন সবাই। আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় রাহাত, রুবেল, কাউছার ও খুদে আড্ডাবাজ সিয়াম। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে শুরু হয়ে যায় খেলা। মোরগ লড়াই দিয়ে শুরু হয়। বিজয়ীকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় আলুর চিপস।
কোত্থেকে যেন এসে হাজির হয় একগুচ্ছ লাটাই। জানা গেল, উৎসবের জন্যই এখানে মজুত ছিল সেগুলো। পছন্দের রঙের ঘুড়ি বেছে নিয়ে ওড়াতে শুরু করলাম। যদিও বাতাস ছিল না, তবু অনেক বছর পর ঘুড়ি ওড়ানোর সীমাহীন রোমাঞ্চ হরফে লেখা যায় না। আমার ঘুড়িটা সেদিন বটগাছে আটকে গিয়েছিল।
নদী পর্ব
শহরের বসার ঘরের দেয়ালে গ্রামের যেসব ছবি ঝোলানো থাকে, গাছতলা সেরকম সুন্দর গ্রাম। ঘুরি ওড়ানো শেষে দল বেঁধে আমরা জামা–কাপড় ছেড়ে নদীতে নেমে যাই। কেউ লুঙ্গি, কেউ হাফপ্যান্ট পরে। সাঁতারের নামে দাপাদাপি করতে থাকল কেউ কেউ। সেখানকার স্থানীয় শিশুরা ডলফিনের মতো। জলে ওদের হুটোপুটি দেখে মনে হচ্ছিল, নদীতে না, মায়ের কোলের ভেতর সাঁতরাচ্ছে।
অনেক দিন পর সেদিন নদীতে নেমেছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। আনন্দ হচ্ছিল তাঁর। আমরা বুক পানিতে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। কি এক হতাশার কথা ভাগাভাগি করতেই তিনি আমাকে বললেন, তোমরা যারা মেডিটেশন করো, তাদের নেতিবাচক চিন্তা করা ঠিক না। ভালো মেডিটেটরদের চিন্তাগুলো প্রকৃতিতে কড়া ইমপ্যাক্ট রাখে।
মাছ ধরা ছোট্ট একটা নৌকা চালানো গিয়ে দেখলাম, কাজটা সহজ না। বরং সিয়ামের টায়ারের ভেতর নিজেকে গুঁজে দিয়ে খানিক দূর ভেসে গেলাম। কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম মাঝনদীতে। আমাকে উদ্ধার করলেন মিজান ভাই। সেখান থেকে টেনে নৌকায় তুললেন।
দুপুরে আলু ভর্তা, সবজি আর ডাল দিয়ে পেট পুরে ভাত খেলাম আমরা। ইলিশের দুই ধরনের তরকারি আর ভাজি ছিল। আজিজের বোন রিনা আপার রান্না মুখে দিয়ে মনে হলো, বহুদিন পর ঘরের রান্না খাচ্ছি। খাওয়া শেষে আবার গরুর দুধের চা নিয়ে বসি খেয়াঘাটে। আমি চায়ে কিছু মেশাই না; না চিনি না দুধ। খাঁটি দুধ পেয়ে তাই কাপ ভরে নিয়ে বসলাম।
বিকেলে দল বেঁধে গেলাম খাজা এনায়েত উল্যাহ একাডেমীতে। গাজী আবদুর রহমান পাঠাগার এ একাডেমীর শিশুদের শিক্ষাবৃত্তি দেবে। শিশুদের সার্টিফিকেট ও পুরস্কার তুলে দিলেন আসাদ ভাই। চাঁদপুর সদরের ৮ নম্বর বাগাদী ইউনিয়নের খাজা এনায়েত উল্যাহ একাডেমী, ইকরা আদর্শ কিন্ডারগার্টেন, পিপলস কিন্ডার গার্টেন এবং এ খায়ের কিন্ডার গার্টেনের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারী মোট ৬০ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হলো। আসাদ ভাইসহ আমরা খাজা এনায়েত উল্যাহ একাডেমীর মাঠে কিছু গাছের চারা লাগালাম।
সন্ধ্যার পর চাঁদপুরের বাবুরহাট থেকে সবাই রওনা হলো। আমি আর আজিজ থেকে গেলাম। আজিজের মা–বাবাকে দেখতে যাব বলে।