হিমেল বরকতের সেরা কবিতা

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

মনে-প্রাণে কবি বলতে যা বোঝায়, হিমেল বরকত ছিলেন তাই। শুধু ‘কবি’ পরিচয়ে অনেক কিছু থেকে তাঁকে দূরে ঠেলে রাখা যায় না। কারণ তাঁর সহোদর কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে যেভাবে কেবলই কবি পরিচয় দেওয়া যায়, হিমেলকে সেভাবে দেওয়া যায় না। তিনি বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম অভিভাবকও ছিলেন।

হিমেলের নাম রেখেছিলেন তাঁর দাদা রুদ্র, যিনি নিজেই নিজের নাম বদলে কবিতাচর্চা শুরু করেছিলেন। হিমেলের ওপর তাঁর দাদার প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল। তাঁর রুচি গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন রুদ্র। হিমেল ছিলেন ভালো ছাত্র, গোছানো মানুষ। কৈশোর থেকেই পরিপাটি হিমেল সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন তাঁর সব লেখাপত্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পর দেখা গেল, হিমেল একজন উৎকৃষ্ট গবেষক হয়ে উঠেছেন। ফলে কবিতা লেখায় পরিপূর্ণ মন তিনি দিতে পারেননি। গোগ্রাসে পড়েছেন, গবেষণা করেছেন, পড়িয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পথে নেমে একদিকে হয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরাগের পাত্র, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরাগভাজন। তাঁর কবিতায় সেসবের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। ‘বৈশ্যবিদ্যালয়’ সিরিজে তিনি লিখেছেন—

যেভাবে বুদ্ধিবিক্রেতা স্বার্থান্ধ মগজে লিখে যাচ্ছে
আনুগত্যের দলিল, যেভাবে চাকরিদাতার কাছে
মেরুদণ্ড নুয়ে আছে জাতির মেরুদণ্ড-নির্মাতা —
সেভাবে আমিও হবো সম্পূর্ণ ভেজালমুক্ত দাস।

হিমেল বন্ধুবৎসল ছিলেন। মানুষ হিসেবে তাঁর মতো বিনয়ী, অকপট বাঙলা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না, বাঙালির মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। পরিবারের প্রতি দায় ও দায়িত্বের দিক থেকেও তিনি যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শ্রম দিয়ে দাদার রচনাসমগ্র যেভাবে তিনি সম্পাদনা করেছেন, তা অনেকেই কাছ থেকে দেখেছেন। হিমেল গানও লিখেছেন, বাংলালিপি প্রকাশ করেছে গানের বই। সেসবের বেশ কিছু গান সুর করেছেন কজন বন্ধুস্থানীয় সুরকার। শেষ দিকে কয়েকটি শিশু-কিশোর উপযোগী বই নিয়ে তাঁর মধ্যে বেশ তাড়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেগুলো লেখাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। চলছিল অলংকরণের কাজ। প্রকাশের সুযোগটুকু আর প্রকৃতি তাঁকে দেয়নি। বন্ধুমহল হয়তো জানবে, হয়তো একমত হবেন, অতিরিক্ত ধূমপান তাঁর মৃত্যুর প্রধান কারণ।

রুদ্র সবার বড়, হিমেল সবার ছোট। তাঁরা দুজনই অকালে চলে গেলেন বাঙলা ভাষা, সাহিত্য ও প্রকৃতিকে ফেলে। হিমেল শান্তি লাভ করুন। হিমেলের স্মরণে, তাঁকে জানাতে ও তাঁর কবিতা সম্পর্কে ধারণা দিতে এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছু কবিতা এই সংকলনে রাখা গেল। আগ্রহীরা বাকিটা খুঁজে নেবেন কবির প্রতি ভালোবাসা থেকে।

হিমেল বরকত ১৯৭৭ সালের ২৭ জুলাই বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার মিঠেখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। পড়াশোনা করেছেন মোংলার সেন্ট পলস হাই স্কুল, ঢাকার নটরডেম কলেজ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।

তাঁর কাব্যগ্রন্থ চোখে ও চৌদিকে (২০০১), বৈশ্যবিদ্যালয় (২০১৩), দশমাতৃক দৃশ্যাবলি (২০১৪), গবেষণাগ্রন্থ সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু (২০১৩), প্রান্তস্বর: ব্রাত্য ভাবনা (২০১৭)।সম্পাদনা করেছেন দুই খণ্ডে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচনাবলী (২০০৫), কবি ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতাসমগ্র (২০০৫), চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও প্রাসঙ্গিক পাঠ (২০১২), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১২), বাংলাদেশের আদিবাসী কাব্যসংগ্রহ (২০১৩), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ স্মারকগ্রন্থ (২০১৫), গানের বই— গানের ঝরা পাতা (২০১৭)। এ ছাড়া শিশু ও কিশোরদের বেশ কিছু বই তিনি লিখেছিলেন যেগুলো তার মৃত্যুর আগে প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল।

হিমেল বরকত ২৭ জুলাই ১৯৭৭ – ২২ নভেম্বর ২০২০

চলুন পড়ে নেওয়া যাক তাঁর কিছু কবিতা

মৌলিক দূরত্ব

আলোর সাপেক্ষে বাড়ে ছায়া,
তোমার দূরত্বে বাড়ি আমি।
দৈর্ঘ্যে প্রস্থে যতটা সম্ভব
চূর্ণ চিৎকারে ছড়িয়ে যাই—

ভ্রূ কুচকায় পাতাদের পিতা,
জিরাফের গলায় পা রেখে
তবু বেড়ে উঠি! ছুটে যাই
নভঃ থেকে নীলে। অবশেষে,

নৈকট্যের কাছে গিয়ে দেখি—
ছায়া পড়ে আছে, তুমি নেই…

সহোদরা

ঘাম ও অশ্রুর স্বাদ এক।
অশ্রু ও ঘামের বর্ণ এক।

প্রতিটি ঘামকূপ আরেকটি
দেহ ডুবে যাবার পর্যাপ্ত
জল রাখে। অশ্রুও ভিজিয়ে
দিতে পারে সমগ্র বয়স।
তবু, এই দুই সহোদরা
আজন্ম শত্রুতা করে গেল।

ঘামের বাড়ির নাম : ‘এসো’।
অশ্রুর বাড়ির নাম : ‘যাও’।

প্রস্তাবনা

সব কেন শুনতে চাও মুখে?
নিজে কিছু পড়ো। নিঃশ্বাসের
তাপ, ঘামের গরিমা— ছুঁয়ে
দ্যাখো। ভেজা চোখ দেখে শেখো।

ঠোঁটের লালায় ঠোঁট চেপে
শুষে নাও অলীক অসুখ।
এতেও সংক্রামিত না হলে
সন্ন্যাসিনী, ক্ষতি নেই। তবু,

মুখেই শুনতে চেয়ো না সব—
যে-মুখে মানুষ মিথ্যে বলে।

বাণিজ্যনামা

তোরেই চেয়েছি আগাগোড়া।

এক আনা, দুই আনা দিবি
এরে-ওরে; তিন আনা রাখবি
মাটির ব্যাংকে— এমন খুচরা
ব্যবসা তো লেখে মুদির খাতা!

আমি যে সওদাগর— যেখানে
ভিড়ি, পানসির গলা ডুবায়
সওদা ভরে আনি। পাঁচ আনা,
ছ’ আনায় তেষ্টা মেটে না রে—

আমি তোর ষোল আনা চাই।

একাকী একতারা

একটি নয়— দু-দুটি পাত্রই
তুমি উপুড় করলে নিজস্ব
ত্বকে। বাইরে বাটির লাবণ্য।
ভেতরে অমৃত, নাকি বিষ—

জানাই হল না। পতঙ্গের
অগ্নিতৃষ্ণা নিয়ে প্রতিরাতে
আত্মাহুতি দিয়ে যাই। বলো,
দুগ্ধপ্রিয় শৈশবের স্মৃতি—

কোন্ বৃন্তে তুমি ছিলে, কোন্চু
মুকের শেষে এতো একা?

মৌল স্বভাব

প্রকৃত বকুল সুতো পেলে
মালা হয়ে ওঠে। কত তুলো
তবু উদাসীন উড়ে গেল!

জল ও মুঠোর অমীমাংসা
দেখে, ঝ’রে-পড়া শিখে নিল
পাতা। পালকেরও একই দোষ—
ঝরে, ঝ’রে গিয়ে পঁচে যায়…

পতনের সম-মেধা নিয়ে
প্রকৃত বিষাদ— সুতো পেলে
আজো তবু মালা হয়ে ওঠে।

অভিমান

জানো মা        ঘেন্না লাগে দেখে
ছেলেটি           তাকিয়ে থাকে শুধু
বিকেলে          পাশের ছাদে উঠে
কী যেন           চোখের স্বরে বলে

মা ওকে           দাও না বকে খুব!

দুপুরে             ক্লাসটা শেষ করে
আমি তো      ছাদেই এসে বসি
ও কেন          মিলির কাছে যায়
মিলি কি       আমার চেয়ে ভালো

মা ওকে        বকতে গেলে কেন?

ভয়

বড় ভয় পাই, যদি তুমি
কোনোদিন জানো, জেনে যাও—
কেন ছুটে আসি, কেন রোজ
হাত পেতে থাকি দরোজায়!

এখানে বণিক-ভদ্রতা :
কিছু নিতে হলে, দিতে হয়।
কী আছে আমার— বারবার
তোমাকে দেখার লোভ ছাড়া!

তাই, ভয় হয়— যদি তুমি
সেটুকুও চেয়ে বসো শেষে!

আহা দুষ্টু স্বপ্ন

এ কেমন উল্টো নিয়ম—
ঘুমালেই ভেঙে যায় ঘুম!

গাঢ় এক ছায়া হেঁটে এসে
উঠে পড়ে শরীরের ’পর
মিহি হাত— তবু তার ফাঁসে
ভাঙে যেন কণ্ঠার হাড়।
টের পাই, রতিঘ্রাণ শেষে
মনে আজো আদি সেই জ্বর।

ঘুমালেই ঘুম ভেঙে যায়—
ঘেমে উঠি তোমার কৃপায়।

ক্ষুধাতত্ত্ব

আমি তখন ক্ষুধায় ছিলাম কাতর
ত্বকের মধ্যে, শিরার মধ্যে ক্ষুধা।
একটি রুটি টুকরো টুকরো ছিঁড়ে
মুখের সামনে দোলাচ্ছিল দ্বিধা।

খাই কি, না-খাই— এমন অবিশ্বাসে
রুটিটির সেই নির্মম ব্যাকুলতা
নিজেকে হায় নিজেই ফেলল খেয়ে।
ভরপেটে তাই ঠোঁট চেটে শূন্যতা

আজকে আমায় শোনায় নিঠুর বাঁশি—
হারিয়ে পেলে পাওয়ার চেয়ে বেশি।

সিদ্ধকাম

পরান যায় না দ্যাহা। তা না
হলি, কেডা এ আগুনে ডোবে!

হাওয়াই মিঠার ছাঁচে গড়া
মরদের হিয়া— বুঝি নাই,
ছুঁয়া পেয়ে ভস্ম হয়ে গেছে।
আমারেও চেয়েছে বানাতে
পোড়া ছাই। আন্ধারের হাতে
দিছে তাই বেচে। বেঁচে গেছি।

যা যায় না দ্যাহা— তা যে আইজ
দ্যাহানো লাগে না নাগরে রে…

উড়ে যাও চিঠি

পত্র লিখিতে বিলম্ব হইল।
গোস্যা করিও না। বড় দ্বন্দ্ব।
ছেলে কি মেয়ে— জানি না। জানি—
তোমার কামনা বাড়ে পেটে।

যে-ছায়ার সাথে ঘর করি
তার আড়ালে তোমারই দেহ।
তোমার দু’ চোখ তার চোখে
দেখে, আমাকে দেখাই খুলে।

তুমি দ্যাখো কিনা— সেই দ্বন্দ্বে
পুড়িতেছি। ভালো আছো তুমি?

বৈশ্যবিদ্যালয়-৯

বণিক-সময় যায়। কী দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে দিন!
প্রভু, আমিই কি শুধু পড়ে থাকবো অবিক্রীত? একা?
দয়া করো, দয়া করো — বিক্রি হতে দাও, স্থিতি দাও।
অন্তত একজন ক্রেতা ত্রাতা হয়ে আসুক জীবনে।

জমিদার, মহাজন হতে হবে — এমন ক্রেতার
স্বপ্ন নেই। তুচ্ছ আমি — মুদির দোকানে যেরকম
বিক্রি হয় ডাল-আলু, সেভাবেই কিনে নিক কেউ।
শুধু ললাটে নিঁখুত মুদ্রিত চাই বিক্রির তক্‌মা।

এ সময়ে অবিক্রীত থাকা মানে পাপ, ক্রটিপূর্ণ।
না-দেখা চোখের ভাগ্যে ঝুলে আছে সমস্ত শিরোপা
না-বলা মুখেই পড়ছে প্রাপ্তির অমৃত সঞ্জীবনী
সত্যকে দেখা ও বলা এখানে গর্হিত অপরাধ।

আমিও পারবো আজ প্রভুভক্ত কুকুরের মতো
পায়ের সুঘ্রাণ নিয়ে হেসে-খেলে কাটাতে জীবন।
অসংকোচে একে-একে জমা দেবো মনিবের হাতে
উপড়ে তোলা চোখ, জিভ, সাহসের উন্মুলিত ডানা।

যেভাবে বুদ্ধিবিক্রেতা স্বার্থান্ধ মগজে লিখে যাচ্ছে
আনুগত্যের দলিল, যেভাবে চাকরিদাতার কাছে
মেরুদণ্ড নুয়ে আছে জাতির মেরুদণ্ড-নির্মাতা —
সেভাবে আমিও হবো সম্পূর্ণ ভেজালমুক্ত দাস।

বিশ্বাস হয় না প্রভু? প্রার্থণাকে কাব্যময় করতে
আমি কোনো কল্পচিত্রে এতোটুকু কাটিনি সাঁতার।
পুরোটাই সত্য এর — এমনই সময় বয়ে যায়।
প্রভু, প্রভু, দয়া করো — বিক্রি হতে দাও, বিক্রি বিক্রি …

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

আরও লেখা

আলো ভাগাভাগি করে বাঁচি

যে কোন পরামর্শ, সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করুন