রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পাঁচ কবিতা

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

ভালোবাসার সময় তো নেই

ভালোবাসার সময় তো নেই
ব্যস্ত ভীষণ কাজে,
হাত রেখো না বুকের গাড় ভাঁজে।

ঘামের জলে ভিজে সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছে পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।

কাজের মাঝে দিন কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্ণাকে ছোঁয় ঘড়ায় তোলা জল।

নদী আমার বয় না পাশে
স্রোতের দেখা নেই,
আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।

তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল সামাজিক নোখ।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প

তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত
করলো তার মুখ।

থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা –
রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত
ঝরে পড়লো কংক্রিটে।

মা…..মাগো….. চেঁচিয়ে উঠলো সে।
পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-
খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।
পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ
ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টসটসে আঙুরের
মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো।

দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের
মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না।
তাকে চিৎ করা হলো।
পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট,
কালো ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের
কথা বলেছিলো ,
বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা।

সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার
কথা বলেছিলো –
বুঝি সে-কারণে ফর ফর
করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার
সার্ট।
প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন
বিবস্ত্র , বীভৎস।

তার দুটো হাত-মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত
মিছিলে পতাকার
মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে,
বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত
ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত , জীবন্ত মানুষের
হাত।

তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ,
ভায়ের শরীর,
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে -আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত
সাথীর হাত ,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের
জীবন্ত উপমা।

লোহার সাঁড়াশি দিয়ে,
একটি একটি করে উপড়ে নেয়া হলো তার
নির্দোষ নখগুলো।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।

সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে
থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত ,
তাজা লাল রক্ত।

তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের
দুর্বিনীত লাভা ….

অভিমানের খেয়া

এতদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই,
পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।

প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,
নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-
এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন!
কিছুটাতো চাই- হোক ভুল, হোক মিথ্যো ও প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন- আর কতোদিন?
ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতটা বিলাবে?
কতো আর এই রক্ত তিলকে তপ্ত প্রণাম!
জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়?

এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়।
তুমি জানো নাই- আমি তো জানি,
কতটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান,
এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি।

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন,
এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।

তুমি জানো নাই- আমি তো জানি।
মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে,
মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে,
যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু,
করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।

পরাজয় এসে কন্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা,
চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক।
তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,
পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।

বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ,
পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়-
ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন?
নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতটা জীবন?
কতোটা জীবন!!

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর

সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখি
যে-রকম আকাশ পৃথিবী দ্যাখে, পৃথিবী আকাশ,
একবার অন্ধকারে, একবার আলোর ছায়ায়
একবার কুয়াশা-কাতর চোখে, একবার গোধুলির ক্লান্ত রোদে-
সারারাত স্বপ্ন দেখি-সারাদিন স্বপ্ন দেখি।
একখানি সুদূরের মুখ জ্ব’লে থাকে চেতনার নীলে,
কে যেন বাদক সেই স্বপ্নের ভেতরে তোলে বিষাদের ধ্বনি
আঁকে সেই প্রিয়মুখে-সুদূরের মুখে
বর্ণময় রঙিন বিষাদ।

ফিরে আয় বোলে ডাকি- সে বাদক উদাসিন থামে না তবুও…
সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখি-
স্বপ্নের ভেতরে তুমি হে আমার বিষণ্ন সুন্দর
চোখের সমুখে আজ কেন এসে দাঁড়ালে নিঠুর!
কেন ওই রক্তে-মাংসে, কেন ওই নশ্বর ত্বকের আবরণে
এসে আজ শুধোলে কুশল?

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর
হৃদয়ের কূল ভেঙে কেন আজ এতো জল ছড়ালো শরীরে
কেন আজ বাতাসে বসন্ত দিন ফিরে এলো কুয়াশার শীতে!

কে সেই বংশীবাদক স্বপ্নের শিয়রে বসে বাজাতেন বাঁশি
বেদনার ধ্বনি তুলে রাত্রি দিন, সে আজ হারালো কোথায়?

বেদনার রঙ দিয়ে আমি যারে আঁকি
হৃদয়ের রক্ত দিয়ে আমি যারে আঁকি
আমার কষ্ট দিয়ে, আমার স্বপ্ন দিয়ে যে আমার নিভৃত নির্মাণ
সেই তুমি- হে আমার বিষণ্ন সুন্দর
মর্মমূল ছিঁড়ে এসে ঠাঁই নিলে কেন এই মাংসের বুকে!
কেন ওই বৃক্ষতলে, কেন ওই নদীর নিকটে এসে বোলে গেলে
তোমার ঠিকানা!

আমি তো প্রার্থনাগুলো শস্যের বীজের মতো দিয়েছি ছড়িয়ে
জল তাকে পুষ্টি দেবে, মাটি তাকে ভূমি দেবে, তুমি তার গভীর ফসল-
বাতাসে তুলোর মতো তুমি তবে উড়ে এলে কেন!
কেন আজ পোড়া তুষের গন্ধে শুধু জন্মের কথা মনে পড়ে!
শৈশব কৈশোর এসে মিশে থাকে ফাল্গুনের তুমুল হাওয়ায়
একটি রাত্রি কেন হয়ে ওঠে এতো দীর্ঘ দীর্ঘ রাত?

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর
দু’চোখে ভাঙন নিয়ে কেন এই রুক্ষ দুঃসময়ে এলে
কেন সমস্ত আরতির শেষে আজ এলে শূন্য দুখানি হাত!
কেন এলে, বিষণ্ন সুন্দর, তুমি কেন এলে?

বাতাসে লাশের গন্ধ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা, -একি তবে নষ্ট জন্ম?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন।

বাতাশে লাশের গন্ধ-
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ-
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমোতে পারিনা-

রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

আরও লেখা

ভেনিসে সেরা হল যারা

শেষ হল এ বছরের ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। গত ৩১ আগস্ট শুরু হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো এ চলচ্চিত্র উৎসব। ৭৯তম এ উৎসবের

বিস্তারিত...

আলো ভাগাভাগি করে বাঁচি

যে কোন পরামর্শ, সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করুন