গ্রামটার সব মেয়ের কাছেই একটা করে স্মার্টফোন। মেমোরি কার্ড ভর্তি হিন্দি গানের ভিডিও আর থ্রি এক্স। বৃষ্টির ভেতর গরুর দুধের ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে এই তথ্যটি যে আমাকে দেয়, তাঁর নাম আকাশ।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। কয়েকটা ডকুমেন্ট প্রিন্ট করাতে সদরে এসেছিলাম। আকাশ কমিউনিকেশন নামের দোকানটা চালায় ছেলেটা। বয়স বাইশ-তেইশ হবে। দোকানে নানা বয়সী ছেলে-মেয়ের ভিড়। দোকানের বাইরে দাঁড় করানো একটা টিনের পাতে লাল হরফে লেখা “গান লোড করা হয়”। কম্পিউটার প্রিন্ট, ফটোকপির সুবিধাও আছে। বিকাশ, ফ্লেক্সিলোডের পাশাপাশি টুকটাক স্টেশনারি বিক্রি হচ্ছে। তবে কমিউনিকেশনের থেকেও বেশি বিক্রি হচ্ছে পাশের টং দোকানের চা। চায়ের গ্লাস হাতে ছেলেপিলে আকাশ কমিউনিকেশনে আসা মেয়েগুলোকে গভীরভাবে পযবেক্ষণ করে। ভিড় থাকলে আমিও এক কাপ চা নিই। সময় নিয়ে খেতে থাকি। ব্যস্ততা কমলে আকাশ নিজে থেকেই ডাকে।
আকাশের কম্পিউটার এখন নিশ্চয়ই ব্যস্ত। হয়তো কোনো কলেজ পড়ুয়া মেয়ের ফোন-মেমোরিতে হিন্দি গানের রগরগে ভিডিও ‘লোড’ দিচ্ছে। সানি লিওন, দিশা পাটানিদের উত্তাল নৃত্য শুধু পুরুষদের টানে তা না। মেয়েদেরও উদ্দীপ্ত করে, জড়তা কেড়ে নেয়।
আকাশ ছেলেটা ইন্টারেস্টিং। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আর পড়ালেখা করেনি। দুই-তিনবার ডকুমেন্ট প্রিন্ট করাতে এসে তাঁর সঙ্গে খাতির হয়ে যায়। অধিকার নিয়েই সে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখে, সঙ্গ পেতে চায়। বেশি ভিড় থাকলে অবশ্য আগে আগে ছেড়েও দেয়। যেমন আজ, জিজ্ঞেস করে, বেশি ব্যস্ত?
আমি হাত তুলে ইশারা করি — ব্যস্ত না, বসছি।
হয়তো হাতের কাজ হালকা করে এসে নিজেই চায়ের দাম দিয়ে দেবে। সিগারেট খেতে বলবে। সে জানে আমি সিগারেট খাই না। তবু আন্তরিকতা দেখানোর জন্য প্রতিদিনই বলবে, ‘খান না একটা সিগারেট। দোকানদার বলে হেলা করেন কেন? কোক খাবেন একটা?’
এক কাস্টমারকে ফিরিয়ে দেয় সে। বলে, ‘বিকাশে টাকা নাই। বিকালে পাবেন।’ কলেজের ছেলে-মেয়েগুলোকে এক এক করে দ্রুত বিদায় করে দেয়। ছোটখাট জিনিস কিনতে আসে যারা, তাদের বলে দেয় — ‘নাই’। অথচ ওসব জিনিস তার কাছে আছে বলেই ছেলেগুলো আসে। হতে পারে, তুচ্ছ জিনিসগুলো নেওয়ার ছুতোয় মেয়েগুলোর পিছু নিচ্ছে তারা। অযথাই দোকানে ভিড় করছে, পযবেক্ষণ করছে। পাঁচ টাকার জিনিস কিনতে এসে মেয়েদের গোপনীয়তা নষ্ট করছে। দায়িত্ববান অভিভাবকের মতো আকাশ মেয়েগুলোকে আগলে রাখে। ছেলেগুলোকে বলে, এখন লোড হবে না।
দুপুর তখন। আবহাওয়ার কারণে বেলা দুইটার সময়ও মনে হচ্ছিল যে কোনো মুহূর্তে অকস্মাৎ সন্ধ্যা নামবে। রাস্তার গর্তগুলোয় বৃষ্টির পানি। দুই একটা বাসের চাকা গর্তে পরে পানি ছড়িয়ে দেয় গর্তের চারপাশে, রাস্তায়। বাসের দরজায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঝুলে থাকা হেলপারের যেন গর্ব হয় তাতে। মনে হয় বাসের হেলপার নয়, যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসা কোনো সেনাদলের যোদ্ধা সে। বাস নয়, যেন চলন্ত ট্যাংকের গায়ে ঝুলে আছে।
শহরে লেখাপড়া করেছি, সাধ ছিল শহরেই একটা চাকরি করব। কপাল খারাপ। অল্প কিছুদিন হলো অফিস থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে চাঁদপুর। গ্রামের নাম গৈরীপুর। উন্নয়নী সংস্থার কাজের আগা-মাথা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। বিদঘুটে এক জরিপের কাজ দিয়ে পাঠয়েছে। বুঝতে পারছি না, এসব তথ্য আমার অফিসের কী কাজে লাগতে পারে।
আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ফেইথ ইন্টারন্যাশনাল। গ্রামের নারীরা কী করে, গৃহিনীর কাজ ও চাকরির পাশাপাশি তাঁদের বিনোদনের মাধ্যম, খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আমাকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আমার সুপারভাইজার পরামর্শ দিয়েছেন, আমি যেন লোকজনের সঙ্গে মিশি। দোকানদার, ভ্যানচালক থেকে শুরু করে সবার কাছেই তথ্য পাওয়া যাবে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়িতে বাড়িতে যাওয়া শুরু করতে হবে। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গেও যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আমার চা দ্রুত ঠান্ডা হয়ে আসে। খাওয়া শেষ হয় না। আকাশ দোকানের ভেতর থেকে মাথা বের করে ডাকে। চায়ের দাম দিয়ে উঠে গিয়ে তাঁর হাতে পেনড্রাইভটা তুলে দিই। কাস্টমার নেই। ভেতরে তখন অনুচ্চ শব্দে একটা হিন্দি গান বাজতে থাকে। আকাশকে বলে দিই, প্রিন্ট নামের একটা ফোল্ডার আছে, সেটার ভেতরের সবগুলো ডকুমেন্ট এক কপি করে প্রিন্ট দিতে।
তৃতীয়বার যেদিন দোকানটায় এসেছিলাম, আকাশ নিজেই পরিচিত হতে চেয়েছিল। মফস্বলে এমন চটপটে দোকানদার দেখা যায় না। ফেসবুকে তাঁর ফ্যান-ফলোয়ার কম না। কথায় কথায় সে জেনে নেয়, তাদের গ্রামে কী কাজে গিয়েছি। শুনে এক মিনিটের মধ্যে সে একটা মৌখিক পরিসংখ্যান দিয়ে দেয়। শেষে বলে, গ্রামটার সব মেয়ের কাছেই একটা করে স্মার্টফোন। মেমোরি কার্ড ভর্তি হিন্দি গানের ভিডিও আর থ্রি এক্স। আমি অবশ্য তাকে বলেছি, একদিন খাতা-কলম নিয়ে বসব।
খাতা-কলম নিয়ে বসার দিন
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার ঠিক আগে বা পরে গ্রামটার বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। বেশিরভাগ পুরুষ থাকেন বিদেশে। নারীরা এখানে রাণির মতো জীবন কাটান। সন্তান লালন-পালন করা ছাড়া তাঁদের আর কোনো কাজ করতে হয় না।
কেউ কেউ বাজারে যান। ঘরে বসে ভারতীয় সিরিয়াল দেখেন। বিদেশে যাওয়ার পর স্বামীরা প্রথম যে জিনিসটা স্ত্রীকে পাঠায়, সেটা হচ্ছে স্মার্টফোন। বিদেশ থেকে কাজের ছুটি নিয়ে গ্রামে কেউ এলে, তাঁর হাতে বাড়ির জন্য টুকটাক জিনিস পাঠিয়ে দেয় অন্য পুরুষেরা। স্মার্টফোন সেই জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তারপর ফোনে ‘এমবি’ ভরে স্বামীর সঙ্গে ভিডিও কলে দেখা-সাক্ষাৎ করেন স্ত্রীগণ। আকাশের দোকান থেকে হিন্দি গান আর থ্রি এক্স লোড করে নিয়ে যায় অনেকে। এক জন নিয়ে যায়, অন্যরা নেয় তাদের কাছ থেকে।
আরও যেসব তথ্য পাওয়া যায় সেগুলো আমাকে চঞ্চল করে না। যেমন কিছু কিছু নারী স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করেন, তবে তাঁদের বেশিরভাগই এলাকার বাইরে থেকে আসেন। বেশ কয়েকজন নারী মিলে একটা সংগঠন করেছেন। তাঁরা দীনের আলাপ আলোচনা করেন। অন্যদের দাওয়াত দেন। বেশ কয়েকজন নারী মিলে একটা সমিতি দাঁড় করিয়েছেন। সেটা কো-অপারেটিভ সোসাইটির মতো। এদের ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো তথ্য দেয় না আকাশ।
আমি মনে মনে একটা খসরা দাঁড় করিয়ে ফেলি। আমার কাজ কমে আসে। এমনকি সব বাড়িতে গিয়ে ফরম পূরণ করতে হবে বলে মনে হয় না। কারণ বেশিরভাগ বাড়ির ঘটনা প্রায় একই। ফরমের নাম আর বাড়ির নাম বদলে দিলেই কাজ হয়ে যেতে পারে। আমার কাজ খানিকটা এগোলেই আরেক জন প্রতিনিধি আসবেন। তিনি ফরম পূরণের জন্য আমার সঙ্গে বাড়ি বাড়ি যাবেন। অলরেডি অফিস আমাকে জানিয়েছে, জরিপের কাজে সহযোগিতার জন্য একজন নারী প্রতিনিধিকে পাঠানো হচ্ছে।
আকাশের দোকানে আরেকদিন আড্ডা বসে। আমরা দুজন গল্প করতে থাকি। দোকানের কম্পিউটারে তখন মোশাররফ করিমের হাসির নাটক দেখতে থাকে তাঁর এক সাগরেদ। আড্ডার বিষয়বস্তু যেদিকে যাচ্ছিল, তাতে আমার একটু বিব্রত লাগছিল। ইশারায় আকাশ বুঝিয়ে দেয়, বেশ সাউন্ডে নাটক চলছে। আমাদের কথা কেউ শুনতে পাবে না।
আকাশ বলে, বাইসাব বিয়া করসেন?
আমি মাথা নাড়ি।
সে বলে, আর কবে করবেন? বাড়িত জায়গা-জমি আছে? ধানি জমি না ভিটা?
যতটা এড়িয়ে আর কম কথায় বলা যায়, আমি সেভাবেই তাঁর সঙ্গে নিজের তথ্য শেয়ার করি। তবে একদিন ছেলেটা আমাকে এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়ে বসে। যেটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। প্রথমে সেটাকে আমার কুপ্রস্তাব মনে হয়েছিল। আকাশের মতো একটা ছেলে মফস্বলে থেকে কী করে সমপ্রেমী হয়ে গেল ভেবে আমি অবাক হই। আমাকে খাতির করা, সময় সময় এটা-ওটা খাওয়াতে চাওয়া দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। কুপ্রস্তাব দেওয়ার পরই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু মুহূর্তেই আমার ভুল ভেঙে যায়। আকাশের কুপ্রস্তাবটি তখন এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রস্তাব বলে মনে হয়।
আমাকে জরিপের কাজে সহযোগিতা করতে এসেছেন শামসুন নাহার নামের এক ভদ্রমহিলা। পেটা শরীর তাঁর। স্কুটি চালিয়ে এসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন ব্যাটাছেলের মতো। শক্ত পাঞ্জা। ভীষণ কাটাকাটা কথা বলেন, ঠিক পুরুষ মানুষের মতো। মনে হয় কাজের বাইরে কোনো কথা বলা তাঁর জন্য নিষিদ্ধ।
বিরক্তিকর কতগুলো কাজ, আকাশ কমিউনিকেশন আর বিশ্রি আবহাওয়ায় আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। গার্লফ্রেন্ড থাকলে তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলা যেত। সেই সুযোগও নেই। ক্যাম্পাস ছাড়ার পর সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম অফিস থেকে যিনি আসবেন, তাঁর সঙ্গে দুই-তিন দিন বেশ আনন্দে কাজ করা যাবে। কাজের পাশাপাশি আড্ডা দেব। কিন্তু পান খেয়ে দাঁত লাল করে ফেলা শামসুন নাহার সে রকম মানুষ নন। প্রথম দিনই তিনি আমাকে একটা শিক্ষা দিয়ে ফেললেন। সেটা রীতিমতো প্রথম রাতে বেড়াল মারার মতো। বলেছিলাম, নাহার আপা, সদরে একটা ভালো চায়ের দোকান আছে। অসাধারণ দুধ চা বানায়। খেয়ে আসি চলেন।
এ কথায় নাহার আপা চোখ ছোট করে আমার দিকে তাকান। বলেন, ছোটবেলায় দুধ কম খেয়েছেন নাকি? আমি যথেষ্ট খেয়েছি। দুধ দিয়ে আমি চা খাই না। আর আমাকে আপা বলবেন না। আমি আপনার কলিগ, নাহার বলে ডাকবেন। মিস নাহার।
আমার চাকরি জীবনের তিনটি দিনকে মিস নাহার শিক্ষাসফরে পরিণত করলেন। বলে দিলেন, বাড়িতে ঢুকব আমি একা। মেয়েদের যে প্রশ্নগুলো করব, পুরুষের সামনে সেসব প্রশ্নের জবাব দিতে তাঁরা সংকোচ বোধ করবেন। আপনি ঘরের বাইরে অপেক্ষা করবেন। বসে বসে মোবাইলে গেমস খেলতে পারেন।
আমি মিস নাহারের পরামর্শ শুনলাম না। ফেসবুক অ্যাপটা চালু করলাম। দেখলাম নতুন ছবি পোস্ট করেছে আকাশ। বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে তাঁকে। একটা সাকোর ওপর সানগ্লাস পরে দাঁড়িয়ে আছে। ছবি তোলা হচ্ছে সেটা সে জানেই না এ রকম ভঙ্গি।
যে বাড়িতে গিয়েছি, সেটার কর্তা থাকেন দুবাই। উঠোনে একটা কালো পালসার মোটর সাইকেল কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন রোদ পোহাচ্ছে কোনো কাউবয়ের ঘোড়া। সেটার পাশেই দাঁড় করানো মিস নাহারের হিরো স্ক্রটি। বাড়ির বাইরে আমাকে একটা চেয়ার দেওয়া হয়েছে। শক্তপোক্ত এক যুবক লুঙ্গি কাছা মেরে আমার সামনেই উঠে যায় ডাব গাছে। শহরে থাকলে এই ছেলেকে দেখে যে কেউ মনে করত নিয়মিত ব্যয়ামাগারে যায়। শরীরের পেশীগুলো বের হয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চার-পাঁচটা ডাবের একটা গুচ্ছ দড়িতে ঝুলে নেমে আসে। খানিক বাদে যুবকও। একটা বটি দিয়ে ঘ্যাচাং করে ডাবের মুখ কেটে ফেলে।
ঘোমটা টানা স্বাস্থ্যবতী এক নারী কাচের একটা জগে ডাবগুলোর পানি জমা করে। গোলগাল আরেক রমণী একটা কাচের গ্লাসে করে আমার দিকে ডাবের পানি এগিয়ে দেয়। ধন্যবাদ দিয়ে পানিতে চুমুক দিয়ে আমি চমকে উঠি। অস্বাভাবিক মিষ্টি পানি। সেটা বুঝতে পেরেই মেয়েটা যেন বলে ওঠে, আর এক গ্লাস নিয়েন। আমার পযবেক্ষণ বলে, এ গ্রামে শীর্ণকায় মেয়ে নেই বললেই চলে। বেশিরভাগই স্বাস্থ্যবতী, গোলগাল।
বেশ কয়েকটা বাড়িতে কাজ করার পর মিস নাহার সেদিন চলে যান সদরে। একটা হোটেলে রুম ভাড়া নিয়েছেন তিনি। আমাকে পালসারে করে নামিয়ে দিয়ে যায় পেশিওয়ালা যুবক হান্নান। স্মার্ট ছেলে, কম কথা বলে। আমার সমান বয়স বলেই মনে হলো তাঁর। যে বাড়িটায় আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, আমাকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় বলে, আকাশের সঙ্গে খুব বেশি মিশবেন না। ছেলেটা ভালো না।
হান্নানের বাইক থেকে আমাকে নামতে দেখে চমকে ওঠেন মিমির মা, মানে হিরকের মা, মানে আমার হোস্ট। ‘ওরে আবার কই পাইলা? ওর লগে মিশ না, সুবিধার পোলা না’, মায়ের মতো শাসনের সুরে তিনি বলেছিলেন কথাগুলো।
হিরক আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। শহরে চাকরি করে। মাঝে মাঝে ইনবক্সে আলাপ হয়। গৈরীপুরে সাত দিন থাকব বলে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। ইনবক্সে সে-ই যোগাযোগ করে। তাঁর গ্রামে থাকব জেনে তাঁদের বাড়িতেই থাকার প্রস্তাব দেয়। তাঁদের বাড়িতে সাত দিন থাকা-খাওয়ার জন্য কত টাকা দিতে হবে, জানতে চাইলে ক্ষেপে যায়, আন্তরিকতা দেখায়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আসার সময় তাঁর মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসব। আমরা একসঙ্গেই গৈরীপুর আসি। নিজেদের বাড়িতে দুদিন থেকে হিরক চলে যায়। বন্ধু হিসেবে তাঁর ঘরেই আমার থাকার জায়গা হয়। তাঁর বোন মিমিকে ছোটবোনের মতো আদর করতে শুরু করি। ঘরের বাইরে থেকে ফেরার সময় তাঁর জন্য ওয়েফার, নয়তো চিপস নিয়ে ফিরি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলেই মিমির বিয়ে। বর সিঙ্গাপুর থাকে। বরের সঙ্গে চুক্তি, মিমিকে লেখাপড়া করাতে হবে।
এক বিকেলে মিমিদের বাসায় আসে আকাশ। ফোন না করে কেন সরাসরি বাসায় চলে এল, বুঝতে পারি না। আমি জামা পরে বাইরে আসতেই হাত ধরে টেনে রাস্তায় নিয়ে যায়। গ্রামের রাস্তাগুলো ভাঙাচোরা, এবড়ো-খেবড়ো। সারি সারি গাছ। গাছের গায়ে ঝোলানো টিনের কালো টুকরো। তাতে সাদা রঙে লেখা ‘সুবহান আল্লাহ’। পাশের গাছে ‘আল্লাহু আকবর’। খানিক পর পর গাছের গায়ে নির্মমভাবে খোদাই করা খোদার নাম। কালো রঙের ওপর সাদা হরফে লেখাগুলো দেখে মনে পড়ে যায় কৈশোরের এক তাবলিগ মুসল্লীর কথা; যিনি বলতেন, গাছের পাতারা সব সময় আল্লার নাম জপ করে।
আকাশ বলে, চলেন এক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাব আজ।
আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাই, কোথায়?
আকাশ মুচকি হাসে। বলে, শোনা লাগবে না, চলেন।
আকাশ আমাকে নিয়ে আসে একটা ছিমছাম গোছানো বাড়িতে। সেখানে ঢোকার সময় চোরা চোখে একটু চারপাশ দেখে নেয় সে। বাড়িটায় ঢোকার সময় আমাদের অভ্যর্থনা জানান রোমেনা নামের এক ভদ্রমহিলা। ফর্সা, হাস্যজ্জল মহিলার চোখে-মুখে আনন্দ ঝলমল করে। পরিপাটি করে পরা শাড়ি তাঁর শরীর ঢাকতে পারছিল না। শাড়ির ব্যর্থতা মহিলাকে আরও আবেদনময়ী করে তুলছিল। ভীষণ আপন স্বরে তাঁকে ভাবী বলে ডাকছিল আকাশ। ভাবী আমাদের জন্য ট্যাঙের সরবত নিয়ে আসেন। সঙ্গে থাকে আপেল, বিস্কুট আর চানাচুর। ভাবীর কাছ থেকে তাঁর মোবাইল ফোনটা চেয়ে নেয় আকাশ। চট করে ভাবীর ফোনের লক খুলে ফেলে। সেটা দেখে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। আর যখন সে নিজের ফোনের শেয়ার-ইট অ্যাপ চালু করে আমার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না।
রসিয়ে রসিয়ে গল্প করেন রোমেনা ভাবী। আকাশের সঙ্গে কম, আমার সঙ্গেই বেশি কথা বলেন। বেশ সম্মানের সঙ্গে নানা কথা জিজ্ঞেস করেন। তাঁদের বাড়িতে গিয়েছি বলে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তেমন কিছু খাওয়াতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। কেন তিনি দুঃখ পান, আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু তাঁর আন্তরিকতা আমার ভালো লাগে। তিনি আমাকে শুক্রবার দুপুরে ভাত খাওয়ার দাওয়াত দেন। এই দাওয়াত আমার ভেতরে সামান্য চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
শুক্রবার আসতে তখনও দুই দিন বাকি। মিস নাহার বৃহস্পতিবার আমাকে ফরমগুলো বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। ফরমে যে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো আছে সেগুলো দেখার পর আমার চিত্ত আরও চঞ্চল হয়ে ওঠে। দুষ্টু বাতাস খেলে যায় শরীর আর মনে। মিস নাহারের সে রকম হওয়ার কথা নয়। মিমিদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তিনি বাইকে স্টার্ট দেন, বলেন, নতুন নতুন কাজ করছেন, কিছু শেখার চেষ্টা করেন। ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে পারবেন।
তার পরামর্শ আমার মাথার অনেক উপর থেকে চলে যায়। মিস নাহার আমার হৃদয়টাকে যতটা ঘিনঘিনে করে দিয়েছিলেন, সেটা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছেন রোমেনা ভাবী। ভদ্রমহিলার ব্যবহারে আমি এতই মুগ্ধ যে, অফিসকে বলেই দিই যে, আমার কাজ শেষ করতে আরও কিছু সময় লাগবে।
শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ে আকাশ এসে হাজির হয় মিমিদের বাড়ির উঠোনে। তাঁকে আগেই বলে রেখেছিলাম, এক কেজি রসমালাই যেন সে মাতৃভাণ্ডার থেকে আনিয়ে নেয়। তাঁর হাতে ঝুলতে দেখা যায় সাদা একটা বাটি। গোলাপী একটা জালের ব্যাগে সেটা ঝুলতে দেখে আমার চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। দুপুরের ক্ষুধা পাকস্তলি থেকে ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে, মনে, মগজে।
রোমেনা ভাবীর খাবারের আয়োজন অসাধারণ। গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ, পটল, ডাল, লাউ দিয়ে মুড়িঘণ্টো। আমি সবকিছু একটু করে চেখে দেখি। গলা পযন্ত খেতে ইচ্ছে করে, ঝুঁকি নিই না। পটলের দোলমা জিনিসটা গ্রামের মহিলারা বানাতে পারে এটা ভাবিনি। যদিও এখন ইউটিউবের যুগ। রান্নার মতো কাজ দ্রুত শিখে নেওয়া কঠিন ব্যাপার না। গরুর মাংসটা মাছের তরকারিকে হার মানিয়েছে। গ্রামে এখন গ্যাস পৌঁছে গেছে। মাটির চুলায় চ্যালা কাঠ ঢুকিয়ে রান্না করা মাংস আর গ্যাসের চুলায় রান্না করা মাংস এক হয় না। তবু রোমেনা ভাবীর মাংস রান্নাটা অসাধারণ লাগে।
খাওয়া শেষে আমরা গিয়ে বসি ভাবীর ঘরে। সেখানে বিরাট খাটের ওপর নতুন চাদর। ভাবী জানতে চান, পান খাব কি না। আমি রাজি হই না। আকাশ হয়। ভাবীকে আজ আরও আকর্ষনীয় দেখায়, সেটা তাকে জানানোর জন্য আমার প্রাণ আনচান করতে থাকে। ভাবী গল্প করতে করতে হঠাৎ বলেন, একটু রেস্ট নেন। আকাশ সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়ে। যেন নিজের বাড়িতে এসেছে। আমার অস্বস্তি হয়। ভাবী বাড়ির আরও গভীরে চলে যান। আমি আকাশকে বলি, এবার? শুয়ে পড়লে যে?
আকাশ বলে, আপনিও শুয়ে পড়েন। রেস্ট নেন। নিজের বাড়ি মনে করতে পারেন। এরা সবাই খুব ফ্রি।
আকাশের হঠাৎ একটা ফোন আসে। ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে বলতে সে চলে যায় বাইরে। আমি মহা অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। কখন ভাবী আসবে আর কখন ঘরটা থেকে বের হয়ে যাব সেই অপেক্ষা করতে থাকি। আমার ঘুম ঘুম পেতে শুরু করেছে। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর বিছানার কাছাকাছি এলেই ঘুম পায়।
রোমেনা ভাবী ঘরে এসে ঢোকেন। ছোট্ট দুটো বাটিতে তিনি নিয়ে আসেন রসমালাই। একটা বাটি রেখে দেন খাটের কাছে থাকা টেবিলের ওপর। অন্যটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন। তাঁর হাত থেকে বাটিটা নিয়ে আমি ধন্যবাদ দিই। বলি, ভাবী, আপনার রান্না খুব ভালো লেগেছে। এই গ্রামে আসার পর প্রথম খুব আনন্দ নিয়ে খেলাম।
রান্নার প্রশংসায় ভীষণ খুশি হন তিনি। বলেন, আমাকে ভাবী বলবেন না। রোমেনা বলে ডাকবেন। আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট। শাড়ি পরি বলে বয়স্ক দেখায়।
আমি তাঁকে উৎসাহ দিই। বলি, শাড়িতে আপনাকে ভালো দেখাচ্ছে।
তিনি হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলেন, কামিজ পরলেও ভালো দেখায়। শাড়ি খুলে কামিজ পরে দেখাই?
তার কথায় আমি লজ্জা পাওয়ার ভান করি। বিষয়টা তিনি উপভোগ করেন। আমার আরও কাছে এগিয়ে এসে বসেন। তাঁর গা থেকে একটা সুগন্ধীর ঘ্রাণ আসতে থাকে। তিনি ফিসফিস করে বলেন, রসমালাইটা খাচ্ছেন না কেন?
তাঁর চাহনি আর স্বরে আমি চঞ্চল হয়ে উঠি।
আমার ঢাকায় ফেরার পালা। কাজগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার পর আরেক মফস্বল এলাকায় পাঠানো হবে আমাকে। মিমিদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মিমির মাকে সালাম করি। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, আবার আইসো।
মিমির হাত ধরে তিন হাজার টাকা গুঁজে দিই। বলি, পরীক্ষার আগে ছোট ভাই-বোনদের দিতে হয় জানো তো? সে খুশি হয়। তার মা অবাক হয়। ঘোমটা দেওয়া মিমি আমাকে খানিকটা এগিয়ে দেয়। বলে, ভাই, সময় পাইলেই আইসেন। আমি কিন্তু ফোন করব মাঝে মাঝে।
আমি সিএনজিতে ওঠার সময় শেষবার এলাকাটায় চোখ বুলিয়ে নিই। গাছের গায়ে আল্লাহর নাম ঝোলে। বাচ্চারা দলবেঁধে স্কুলে যায়, মেয়েরা আলাদা, ছেলেরা আলাদা। এক মহিলার হাত ধরে ছোট্ট একটা বাচ্চা হেঁটে আসতে আসতে আমার পাশ থেকে চলে যায়। মহিলার চেহারাটা চেনা লাগে। জরিপের কাজে মিস নাহারের সঙ্গে তার বাড়িতেই গিয়েছিলাম। বাচ্চাটাকে দেখলে মনে হয় হান্নানের মতো। হয়তো তারই বাচ্চা। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কোন ক্লাসে পড়? বাচ্চা জবাব দেয়, ‘ওয়ানে’।
সেদিনের পর হান্নানের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আকাশ অপেক্ষা করছে সদরে। সিএনজি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটার ভেতরে চালু হয়ে যায় ওয়াজ মাহফিলের অডিও। কিছু দূর যেতেই একজন মহিলা ওঠেন সিএনজিতে। আমি চালককে অনুরোধ করি, যেন ওয়াজটা বন্ধ করে। গ্রামের বাতাসের আওয়াজ, পাখির ডাক শুনতে ইচ্ছে করছিল। লোকটা ওয়াজ বন্ধ করে, কিন্তু তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। এই ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাতো আমার এলাকার তাবলীগের সাথী জিয়া ভাই। আমি তাঁকে বেহেশত-দোজখ নিয়ে নানা প্রশ্ন করে আটকে দিতাম। তিনি আমার দিকে এই সিএনজি চালকের মতো তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকাতেন।
সিএনজি আবার থামে। এবার আরেকজন মহিলা ওঠেন, সঙ্গে বাচ্চা। মহিলাদের গা ঘেসে বসতে ইচ্ছে করে না বলে আমি নেমে যাই। সিএনজির সামনে আসনে গিয়ে বসি। কিন্তু বাচ্চাটাকে দেখে মনে হয়, খানিকক্ষণ আগে একেই তো দেখেছিলাম। মনে হয় হান্নানের বাচ্চা। আগেরটার পরনে অবশ্য স্কুলের জামা ছিল। এর পরণে সাধারণ পোশাক। ঘাড় ঘুরিয়ে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করি, কোন ক্লাসে পড়? বাচ্চাটা জবাব দেয়, ওয়ানে।
সদরে পৌঁছানোর পর আকাশের সঙ্গে এক কাপ চা খাব, কথা দিয়েছিলাম। চা খেতে খেতে তাঁকে জিজ্ঞেস করি, হান্নান ছেলেটা কী করে?
আকাশ সন্দেহ নিয়ে তাকায় আমার দিকে। বলে, কেন?
আমি বলি, না এমনিতেই। একদিন পরিচয় হলো। পরে আর কথা হয়নি। তোমার সঙ্গে কোনো সমস্যা আছে তাঁর?
আকাশের মুখ কেমন যেন শক্ত দেখায়। বলে, সমস্যা তো ছিল না…