কালো সাপের কান্না

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

বালিকা রিকশার বা পাশে, আমি ডান পাশে। মানে রিকশাওয়ালার ডান আর বা পাশ। দুপুরের কড়কড়ে রোদ, প্রায় জনশূন্য রাস্তা। আমার অস্বস্তি পাহাড় সমান।

মেয়েটা কলেজ পালিয়ে এসেছে, ফেসবুকে কবিতা-লেখা একটা লোকের সঙ্গে দেখা করতে। তার কোনো অস্বস্তি নেই। বাসা দেখবে। জানালা দেখবে, ছাদ দেখবে, বেলকনি দেখবে। দেখালাম। অনবরত বাকবাকুম বাকবাকুম করেই যাচ্ছিল। বকবক করে ক্লান্তি নামলে হাত-ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে পানি খাচ্ছিল, একটু থেমে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আবারও বকবক করছিল। তার কত যে কথা! পানির বোতলের গায়ে হালকা ঘাম। বোঝা যায়, বাসা খুব বেশি দূরে নয়। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা বোতল বের করে ব্যাগে ঢুকিয়েছে। সায়েন্সের ছাত্রী, পেনসিল ব্যবহার করতে হয়। চারপাশ নোংরা করবে না বলে পেনসিল ছাঁটা কাঠগুলো ব্যাগের ভেতরেই ভরে রেখেছিল। ঘর্মাক্ত বোতলের গায়ে সেসব জড়িয়ে গেছে।

দুপুর হয়ে আসে। আমার ক্ষুধা পায়, তার পায় না। অতিথিকে না খাইয়ে বিদায় দিলে গেরস্তের নাকি অমঙ্গল হয়। হোক ফেসবুকের জমানা, আমি আজও ওসব সনাতন রীতি মেনে চলি। বাসায় খাবার নাই, রান্নার জন্য ফ্রিজেও কিছু নাই। আন্টি তবু বলে, কিছু রেঁধে দিই? বালিকা রাজি হয় না। রান্না, খাওয়া তারপর যাওয়ায় নাকি অনেক দেরি হয়ে যায় তার।

বালিকা ঘেমে রসগোল্লা। তাকে নিয়ে একটা শীত ও তাপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় ঢুকি। কিছুতেই খেতে চায় না। ভীষণ পীড়াপীড়িতে খানিকটা খায়। খেয়ে আমাকে অপরাধী করে দেয়। বলে, ‘বাসায় গিয়ে যদি না খাই, মা বকবে!’

তাকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিতে রিকশা নিয়েছিলাম। রিকশায় উঠে তার কথায় আমার অস্বস্তি বেড়ে যায়। সে বলে, ‘আমাকে যতটা পচা দেখাচ্ছে আজ, আমি কিন্তু দেখতে ততটা পচা না।’ তার কথা শুনে আমি মুশকিলে পড়ে যাই।

উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া বালিকাটা, গায়ে তার ডাক্তারের মতো সাদা অ্যাপ্রোন। সেটার পকেটে আবার অ্যাম্ব্রয়ডারি করে কলেজের নাম লেখা। অ্যাপ্রনের পিঠে কলমের অসংখ্য আঁকিবুঁকি। বান্ধবীরা নাকি তার পিঠে কলমের কালি টেস্ট করে।

বালিকার চোখের দিকে ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, ঘটনা সত্য। দেখতে যতটা ‘পচা’ ভেবেছিলাম, ততটা পচা সে নয়। চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, একটু নার্সিং করলে ‘এই জংলা লতাখানি পাতাবাহারে রূপ লাভ করিবে’। একবার র‌্যাম্পের ওপর হেঁটে যাবে আর আসবে—বিল দিতে হবে অন্তত হাজার দশ। রোমান্টিক সিনেমার কন্ট্রাক্ট সাইন করলে পাওলি দামের রেট কমে যাবে। সারা দিন নাচ-গান-সিনেমা নিয়ে থাকি। আমার ভাবনা আর কোনমুখী হবে?

চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, একটু নার্সিং করলে ‘এই জংলা লতাখানি পাতাবাহারে রূপ লাভ করিবে’। একবার র‌্যাম্পের ওপর হেঁটে যাবে আর আসবে—বিল দিতে হবে অন্তত হাজার দশ …

বালিকা আমাকে ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘ডুবে গেলেন যে!’

আমি থতমত খেয়ে যাই। ভাবি, বাপরে বাপ, কি পাকনার পাকনা! আমি নাকি ডুবে গেছি! ভাবখানা এমন, তিনি উদ্ধারকারিনী আমির হামজা! ডুবন্ত আমাকে উদ্ধার করলেন।

স্ক্যান্ডাল না থাকলে কবি হওয়া যায় না। তুমি আর কবি-টবি হতে পারবা না। শুধু কবিতা লিখলেই হয় না। কিছু স্ক্যান্ডাল থাকতে হয়। সেই আমলের জীবন বাবু, নজরুল, রবীন্দ্রনাথেরও স্ক্যান্ডাল ছিল

কয়েকটি দুষ্টু প্রকৃতির বন্ধু আছে আমার। প্রায়ই নানা উসকানি দেয়। বলে, স্ক্যান্ডাল না থাকলে কবি হওয়া যায় না। তুমি আর কবি-টবি হতে পারবা না। শুধু কবিতা লিখলেই হয় না। কিছু স্ক্যান্ডাল থাকতে হয়। সেই আমলের জীবন বাবু, নজরুল, রবীন্দ্রনাথেরও স্ক্যান্ডাল ছিল। এই সময়ের হলে ভিডিও–টিডিও থাকত। তোমার হবে না।

আমিও বুঝে গেছি, আমার হবে না। বালিকাকে বললাম, ‘বাসায় যাও। অনার্সে ভর্তি হয়ে পরে আবার আমার কাছে আসবে। ছাদে আড্ডা দেব, বেইলি রোডে ফুচকা খাব। আবার নাও আসতে পারো। ভর্তির খবরটা ফোনে জানিও, একটা উপহার পাঠিয়ে দেব। ভর্তি হতে না পারলে আর যেন আমাকে ফোন করো না।’ শুনে বালিকা কষ্ট পেল।

গ্রীষ্মকাল। তাঁর ভীষণ ইচ্ছে ছিল নিজের হাত খরচের টাকায় আমাকে কিছু লিচু কিনে খাওয়াবে। ব্যাচেলর মানুষ, কি খাই না খাই ঠিক নেই। আমার পক্ষে তার শখ পূরণ করা সম্ভব না। তার বয়সটা ভুল করার, আমার মধু আহরণের। তার ভুলকে প্রশ্রয় দিলে অন্যায় হবে, মধু আহরণ করলে লোকে লম্পট বলবে। তা ছাড়া নিজের কাছে স্বস্তি পাই না। ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে নিজেই বুঝে ফেলবে, কার সঙ্গে রিকশায় আর কার সঙ্গে শয্যায় যেতে হবে। ফেসবুকে কবিতা-লেখা লোক তখন আর তাঁকে আকর্ষণ করবে না। তা ছাড়া যে কথা তাকে বলেছি, তাতে আর যোগাযোগ করারও কথা না।

আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে একদিন এসে হাজির হয় বালিকা। ওই সময়টাতে আমার বাসায় থাকার কথা ছিল না। যেন গন্ধ শুকে চলে এসেছে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। আন্টি কি-না-কি মনে করছে, কে জানে? ঘরে ঢুকেই ব্যাগসহ সুড়ুৎ করে সে চলে যায় বাথরুমে। আমি ভিতু মানুষ। বাথরুমে ঢুকেছে সেটা সমস্যা না! ব্যাগ নিয়ে কেন? কাহিনি কী? নানা কিছু হতে পারে। টয়লেট ব্যবহারের চাপ? থাকতেই পারে। হতে পারে, ন্যাপকিন বদলাবে, হাত-মুখ ধোবে বা একটু সাজুগুজু করবে।

বেশ খানিকক্ষণ পর তিনি বেরুলেন। একটু নয়, পুরোটুকু সাজুগুজু করেই বেরুলেন। পরনে নীল রঙের শাড়ি আর কালো ব্লাউজ। বা কাঁধের কাছে ব্রার ফিতেটা বের হয়ে আছে। ঠোঁটে যথেষ্ট লিপিস্টিক, কপালে লাল একটা টিপও তিনি পরেছেন। এমন একটা ভাব নিয়ে বাথরুম থেকে বেরুলেন, যেন তিনি এই ঘরেই থাকেন।

আমি বললাম, ‘বাহ্, তোমাকে তো বেশ ম্যাচিউর লাগতেসে। শাড়িটা কি মায়ের?’

প্রশংসা শুনে খুশি না হয়ে বালিকা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। ‘কেন, মায়ের হতে যাবে কেন? আমার কি শাড়ি থাকতে নেই?’ আমি চুপ মেরে যাই। সে আমার খাটের ওপর এসে বসে। দুই হাঁটু মুড়ে নিজের দুই হাত চেপে ধরে বসে। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, রাতের পর রাত ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে এই মেয়ের কান্না শুনতে হয়েছে আমাকে। কত যে কষ্ট তার! প্রেমিক প্রতারণা করেছিল বলে কত রাত নিজে ঘুমায়নি, আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। শুধু মন দিয়ে কথাগুলো শুনেছিলাম বলে আজ আমার এই দশা। এসে রীতিমতো ঘরে উঠেছে, হয়তো এবার ঘাড়েও চড়বে। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আমি তার নির্ভরতার কেন্দ্র হয়ে গেছি। এবার কি যৌন দাস হতে হবে?

প্রশংসা শুনে খুশি না হয়ে বালিকা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। ‘কেন, মায়ের হতে যাবে কেন? আমার কি শাড়ি থাকতে নেই?’

ফেসবুকে তাঁর অসংখ্য ছবি। ডিএসএলআরওয়ালা বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় কোথায় যে চলে যায়। হয়তো এভাবেই ব্যাগে ভরে কাপড় নিয়ে যায়। একের পর এক বদলায় আর ছবি তোলে। তোলে আর আপলোড করে। আপলোড করে আর লাইক গোনে। কি লাভ হয় তাতে?.

মেয়েরা জাতশিল্পী, প্রত্যেক মেয়ে। শুধু মধ্যবিত্ত মানসিকতার খাঁচায় ঢুকলেই মেয়েরা গৃহিণী হয়ে যায়। কলেজজীবনে এক সহপাঠিনীকে দেখেছিলাম, কতগুলো ছেলে তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, গুণে রাখত

জিজ্ঞেস করতে হয় না; আমি বুঝি। বিপরীত লিঙ্গের লাইক, প্রশংসাসূচক মন্তব্য মানুষের মনের সাপ্লিমেন্টারি ফুড। বিশেষ করে শিল্পীদের। মেয়েরা জাতশিল্পী, প্রত্যেক মেয়ে। শুধু মধ্যবিত্ত মানসিকতার খাঁচায় ঢুকলেই মেয়েরা গৃহিণী হয়ে যায়। কলেজজীবনে এক সহপাঠিনীকে দেখেছিলাম, কতগুলো ছেলে তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, গুণে রাখত। গর্ব করে বন্ধুদের সেই সংখ্যাটা বলতে ভালোবাসতো সে। এই সময়ের তরুণীরা আরও এক কাঠি সরেস। ইনবক্সে শুধু প্রেমের না, মডেলিংয়ের প্রস্তাবও পায়। অন্য আরও নানা প্রস্তাব পায় কেউ কেউ। ছবি এডিটিং কারিশমার ওপর নির্ভর করে সেসব।

বালিকা আমার জানালাকে পেছনে রেখে অনবরত সেলফি তুলতে থাকে। দেখতে ভালো লাগে। কেমন শিশুতোষ একটা সারল্য। জিজ্ঞেস করি, ‘নুডলস খাবে?’
সে বলে, ‘উঁহু, অন্য কিছু।’
‘অন্য কী?’
‘পরে বলব।’
‘এখনই বলো। বানাতে হবে, নয়তো আনতে যেতে হবে। বিদ্যুৎ গেলে লিফট বন্ধ হয়ে যাবে। স্পাইডারম্যানের মতো হাতে-পায়ে এত উপড়ে উঠতে কষ্ট হবে তখন।’

সে বলে না। বরং টান দিয়ে তাঁর সেলফির ফ্রেমে আমাকে ঢোকায়। এমনভাবে টানে, যেন আমি তাঁর কত দিনের চেনা; বন্ধু বা প্রেমিক।

চিলেকোঠায় থাকি। ছাদের একটা ইউনিট খালি রেখেছে বাড়িওয়ালা। আমাদের ঘর থেকে বেরুলেই ছাদটা বিরাট একটা বারান্দা। ছাদের ওপর আরেকটা ছাদ। রাতে সেই ডুপ্লেক্স ছাদে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে বালিকার সঙ্গে ফোনে গল্প করি, রাতের পর রাত। তারা-খসা দেখি। এক রাতে কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা ফুলের নাম বলে উঠি। অপ্রাসঙ্গিক সেই শব্দে বালিকা বলেছিল, ‘কি হলো, বকুল বকুল বলে কাকে ডাকেন?’

আমি বলি, ‘তারা খসে পড়সে, বুঝলা। তারা খসলে ফুলের নাম নিতে হয়।’ শুনে সে বিস্মিত হয়। দিনের বেলা মায়ের কাছে জানতে চায়, তারা খসতে দেখলে ফুলের নাম নিতে হয় কেন? এই কথা শুনে তাঁর মা নাকি অনেকক্ষণ চোখ বড়বড় করে রেখেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোনো পাগল-ছাগলের সঙ্গে প্রেম করছিস না তো?’

কথা শুনে তাঁর মা নাকি অনেকক্ষণ চোখ বড়বড় করে রেখেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোনো পাগল-ছাগলের সঙ্গে প্রেম করছিস না তো?’

বালিকা একপর্যায়ে ছবি তোলা থামায় সে। আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ‘একটা খেলা খেলবেন?’

আমি চমকে উঠি, থমকে দাঁড়িয়ে যাই। পাথরের মতো শক্ত লাগে দুই পা। নাড়তে পারি না, নাড়তে ইচ্ছেও করে না। কিন্তু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি। বলি, ‘কী খেলা?’

সে এগিয়ে এসে দুই হাত দিয়ে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে। চট করে উঠে দাঁড়ায় আমার পাথরের মতো ভারি লাগতে থাকা দুই পায়ের ওপর। বলে, ‘এবার হাঁটেন।’

আমি এক এক করে কদম ফেলে এগোই, আবার দুই কদম পেছাই। সে খিলখিল করে হাসতে থাকে। তার শাড়ির স্পর্শ শরীরে লাগে, আর শিহরিত হয়ে উঠি। টেরও পাইনি কখন যেন আমি দুই হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে সারা ঘরময় হাঁটতে শুরু করেছি। হঠাৎ সে আমার গলায় স্পর্শ করে তাঁর লিপস্টিক মাখা ঠোঁট। আমি থমকে থেমে যাই। বলি, ‘ঠিক হচ্ছে না কিন্তু।’

তাদের অনেকেরই নাকি লিপস্টিক খাওয়ার অভ্যাস আছে। আমার সহ্য হয় না। আমি তাকে গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা টিস্যু ধরিয়ে দিয়ে বলি, ‘মোছো, নিজে হাতে মুছে দাও। যত খুশি চুমু খাও। লিপস্টিক লাগায়ে খাইতে হবে ক্যান

আমার সত্যিই বিরক্ত লাগে বিষয়টা। বন্ধুদের কাছে শুনি, তাদের অনেকেরই নাকি লিপস্টিক খাওয়ার অভ্যাস আছে। আমার সহ্য হয় না। আমি তাকে গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা টিস্যু ধরিয়ে দিয়ে বলি, ‘মোছো, নিজে হাতে মুছে দাও। যত খুশি চুমু খাও। লিপস্টিক লাগায়ে খাইতে হবে ক্যান?’

বালিকা অপমান বোধ করে। তাঁর চোখ ভিজে ওঠে। সে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। আমি কী করব ভেবে পাই না। বয়সে অন্তত দশ বছরের ছোট সে আমার। এত ছোট মেয়েকে কি বলে শান্ত করা যায় বুঝতে পারছিলাম না। আমি তার দুই হাত চেপে ধরে বলি, ‘সরি। এভাবে বলা উচিত হয়নি বোধ হয়।’

সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবারও বাথরুমে ঢুকে পড়ে। খানিক পর পোশাক বদলে বের হয়। কিছু না বলেই বের হয়ে চলে যায় ঘর থেকে। আমি চুপচাপ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি। মেয়েটার মনের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করি। ওর বয়সটা স্বাভাবিকভাবেই বেপরোয়া। কাঁপা কাঁপা বুকে অসহ্য যন্ত্রণা। এ বয়সে একবার প্রেম ছুটে গেলে মেয়েরা দুর্বার হয়ে ওঠে। প্রথম স্বাধীনতা পাওয়ার পর মানুষ যা যা করতে পারে, সেগুলোর সবই করে। এই মেয়ের অবস্থাও সুবিধার না। বুঝি, তাঁর যৌনচেতনা প্রবলভাবে তাকে তাড়িয়ে এনেছে আমার কাছে। নির্ভরতা পেয়েছে, এবার তাঁর প্রশান্তি দরকার। রাতের পর রাত মন দিয়ে তাঁর কথা শুনে আমি তাঁর নিজের মানুষ হয়ে গেছি। বুঝিয়েছিলাম, কেন তার বয়ফ্রেন্ড অমন আচরণ করেছে। কী করলে, কেন মানুষের জীবনে এই ঘটনাগুলো ঘটে। এমন ঘটলে কী-ই বা করার থাকে।

সবই মেনেছে। বয়ফ্রেন্ডকে ক্ষমা করে দিয়েছে। আমাকে করে না। পুরোনো কথা মনে পড়লে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। সেই কান্না আমাকে শুনতে হয়। একেবারে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় পুরোনো ব্যথা জেগে ওঠার মতো ব্যাপার। আমি হয়েছি তার চাপমুক্তির ঘর। ধার্মিক পুরুষেরা আকাশের দিকে হাত তুলে কাঁদে, আর সে কাঁদে আমাকে ফোন করে কাঁদে।

এ বয়সে একবার প্রেম ছুটে গেলে মেয়েরা দুর্বার হয়ে ওঠে। প্রথম স্বাধীনতা পাওয়ার পর মানুষ যা যা করতে পারে, সেগুলোর সবই করে। এই মেয়ের অবস্থাও সুবিধার না …

সে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর দুই দিন হয়ে যায়। কোনো যোগাযোগ নেই। মনে হয়, কোনো অঘটন ঘটল না তো? তাঁর বড় বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে। দুলাভাইটা ক্লাসমেট। প্রায় রাতেই দুজনের ঝগড়াঝাঁটি হতো বলে আমাদের ফোনে কথা বলা হতো না। দুই বোন প্রায় রাতেই একসঙ্গে ঘুমোত, দুলা মিয়া বসার ঘরের সোফায়। দুই বোনের মাঝখানের ভাইটা বিবিএ শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছে। বাবার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটে একটা গন্ডগোল আছে। চেষ্টা চলছিল, শিগগির সেটা ঠিক করা হবে। তাহলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাটা সহজ হয়ে যাবে তার। আমি বুঝেছিলাম, আর হবে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে হবে তাকে।

কিছু মানুষ থাকে, নিজের বয়সের থেকেও বড় হয়ে যায়, অনেকটা নিজের ছায়ার মতো। বালিকার ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক তেমনটাই। ক্লাসের বাইরের বয়স্ক ছেলে–মেয়েগুলোই ওর বন্ধু। নিশ্চিত করে বলতে পারি, ইতিমধ্যে অন্তত পাঁচজন পুরুষের গভীর সান্নিধ্য সমৃদ্ধ করেছে তাকে। একবার মোবাইল ঘাটতে গিয়ে দেখি ব্রাউজিং হিস্টরি জুড়ে পর্নোগ্রাফির লিংক। এইচডি, ভিআর পর্নো ছবির যুগে সততা ও সতীত্ব দুই-ই টিকিয়ে রাখা শক্ত। ভীষণ শক্ত।

সাত দিন পর মনে তৈরি হলো ভয়! সুইসাইড করে বসলো না তো? বাপটা অন্য জেলায় চাকরি করে। ছুটিছাটায় ঢাকায় এলে বাড়িতে উৎসব। তার ভেতরেও নিয়ম করে ফোন করত সে। আমার তো কথা বলতে খারাপ লাগত না।

কিছুতেই যখন আর ফোন ধরে না, ফেসবুকেও খুঁজে পাই না, তখন একটা মেসেজ পাঠিয়ে রাখি। লিখি, ‘bathroom-e lipstick r 13ta safety pin rekhe gecho. Ami esob babohar kori na. ki korbo egulo?।

সেই রাতে ফোন করে বালিকা। সেই রাতে তাঁর প্রথম বাক্য, ‘আপনার মতো অরোমান্টিক মানুষের কবিতা লেখার দরকার নাই।’ আমি কিছু বলি না। ঝাল ছিটানো শেষ হোক, অপেক্ষা করতে থাকি। সে আর কথা বলে না। পরে আমাকেই শুরু করতে হয়। বলি, ‘রাগ করে তোমার রেখে যাওয়া লিপস্টিকটা নষ্ট করে ফেলসি। তবে অ্যামাজন থেকে তোমার জন্য একটা ফ্রেঞ্চ লিপস্টিক কিনসি, লোরিয়্যাল। দাম বেশি না, মাত্র ১৩ ডলার। কিন্তু খুব সুন্দর। সেফটিপিনগুলো নিতে এলে লোরিয়্যালটা নিয়ে যেও।’

সে সকালেই আসবে জানার পর আমার ভেতরের লোভী কুকুরটা জেগে ওঠে।

রাত পেরোলে ভাবনারা আলোকপ্রাপ্ত হয়। বালিকা আমাকে আরও আলোকিত করে তোলে। একটি সেফটিপিন দিয়ে অন্যটিকে আটকে আমার তালুতে দিয়ে বলে, ‘এটা স্যুভেনির। বাকিগুলো নিয়ে গেলাম।’

এবার আর তাকে সুযোগ দিই না। কাঁধে হাত রেখে বলি, ‘ভীষণ কষ্ট পাইসো না? আমরা না ফ্রেন্ড? ফ্রেন্ডের সঙ্গে কেউ ওসব করে বলো?’

বালিকা চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?’

আমি বলি, ‘না। বড় জোর প্রেম করতে পারি।’

বালিকা রসিকতাচ্ছলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘আপনার মতো বুইড়ার লগে প্রেম করমু না।’

একটি সেফটিপিন দিয়ে অন্যটিকে আটকে আমার তালুতে দিয়ে বলে, ‘এটা স্যুভেনির। বাকিগুলো নিয়ে গেলাম …

আমি তাকে অবিরাম কাতুকুতু দিতে দিতে বলি, ‘ওরে আমার রূপবান। একটা রহিম জুটবে কপালে তোমার। কোলে নিয়ে প্রেম কইরো।’ সে হেসে লুটিয়ে পড়ে বিছানায়, আমি থামি না। সে শুরু করে হাত-পা ছড়িয়ে কিল-ঘুষি। একপর্যায়ে সে আমার ওপরে চড়ে বসে অবিরাম কিল-ঘুষি দিতে শুরু করে। মাথাটা বাঁচিয়ে কোনো রকম ঠেকাই সেসব। অমন একটা আটার বস্তার নিচে পড়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তার ওপর আবার মার! মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে কানের ওপর একটা ভালো রকম কামড় বসায় সে। মনে হয়, কানটা কামড়ে বোধ হয় খেয়েই ফেলেছে। ভীষণ জ্বলতে থাকে জায়গাটা। কিচ্ছু বলতে পারি না।

বালিকা ঘেমে একাকার হয়ে ঢুকে পড়ে বাথরুমে। আমি চিৎ হয়ে নিশ্বাস নিতে থাকি। অপেক্ষা করতে থাকি, আপদ কখন বিদায় হবে। অফিসে যেতে হবে।

কতক্ষণ বিছানায় ওভাবে পড়ে ছিলাম। দেখলাম আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল সে, সম্পূর্ণ উলঙ্গ। গোসল করেছে সম্ভবত। আমি তাকে বলি, ‘একটা গল্প শুনবা?’

সে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বলেন।’

একটা অল্প চেনা মেয়ে উলঙ্গ অবস্থায় গলা জড়িয়ে ধরে গল্প শুনতে চাইলে অবস্থাটা যা দাঁড়ায় … আমারও তাই হলো। আমি তাকে পরাস্ত করার জন্য বললাম, ‘আমার একটা অ্যাফেয়ার ছিল। মিলিত হওয়ার পর সে এভাবেই তোমার মতো গলা জড়িয়ে থাকত। আর আমি কি করতাম জানো?’

‘কি করতেন?’

‘কবিতা শোনাতাম।’

‘আজ তোমাকে একটা কবিতা শোনাই। কবিতাটা শুনে তুমি যত দ্রুত সম্ভব ভেগে যাও।’

বালিকা বলল, ‘আপনার গার্লফ্রেন্ডকে আপনি কত ভালোটাই না বাসতেন। আমার বয়ফ্রেন্ড আমার সঙ্গে কী খারাপ ব্যবহার করল, ছিঃ ছিঃ’, বলেই সে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। একটা শ্যামবর্ণের মেয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে আমার বিছানায়, আমারই পাশে শুয়ে কাঁদছে! ভয়াবহ এ দৃশ্য আমার ভেতরে বিভ্রম তৈরি করে। মনে হয়, একটা কালো সাপ আমার পাশে শুয়ে কাঁদছে। আমি নির্বিকার সেই সাপের কান্না শুনতে থাকি।

বালিকাকে যে কবিতাটি শুনিয়েছিলাম, সেটি শেয়ার করার লোভ সামলানো গেল না। দুঃখিত।

… সব নদীতে নামতে নেই / উষ্ণতারা এক না হলে ঘামতে নেই / না মিললে পথের দিশা থামতে নেই / স্বর্ণালি ধান চাল না হলে ভানতে নেই / দুঃখ পেলেও সব প্রহরে কানতে নেই / একগাদা এই নেইয়ের পদ্য শুনতে নেই / আমার মতো বোকার কথা মানতে নেই / সেফটিপিনের গোপন ব্যথা জানতে নেই …

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

আরও লেখা

আলো ভাগাভাগি করে বাঁচি

যে কোন পরামর্শ, সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করুন