সালমানের আগুন, আগুনের সালমান

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

একজন মানুষ বিলীন হয়ে গেলেন আরেকজন মানুষের ভেতরে। ঠিক মানুষ নয়, শিল্পী। একজন শিল্পীর কাজকে একেবারে নিজের কাজ বানিয়ে নেওয়ার জাদু দেখা যায় বড় পর্দায়। সেই কাজটি করেছিলেন যে জাদুকর, তাঁর নাম সালমান শাহ। পর্দায় সালমান শাহর গানগুলো নিয়ে শুরুতে দর্শকমহলে এমনও শোনা যেত, এগুলো সালমান শাহর নিজেরই গাওয়া। নিজের গান যখন হয়ে যায় সালমানের গান, তাতে আপত্তি থাকে না শিল্পী আগুনের। বরং নব্বই দশকে নিজের গাওয়া গানগুলোকে তিনিই এখন বলছেন, ‘সালমানের গান।’

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার কথা। শিল্পী আগুনের মগবাজারের বাসায় চলে যাই তাঁর বন্ধু সালমান শাহকে নিয়ে কিছু শোনার জন্য। লিফটের মুখ থেকে বসার ঘরে নিয়ে যান শিল্পী। তাঁর পরনে মেরুন রঙের প্যান্ট। কালো পোলো শার্টের বোতামগুলো খোলা, কলার উঁচু করে রাখা। সাদামাটা ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করেন শতাধিক ছবির প্লেব্যাকের এই শিল্পী। কথার শুরুতেই থেমে যান, ভেতরের ঘরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চায়ের কথা মনে করিয়ে দেন।

আগুন-সালমান শাহ প্রাণের বন্ধু। দুজনের মায়ের নামই নীলা। তবে দুজনের আড্ডার সুযোগ ছিল খুবই কম। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবি মুক্তির পর সালমান শাহ, মৌসুমী বা আগুন কারও দম ফেলার অবসর ছিল না। সে সময় মাত্র বাইশ বছরের তরুণ তাঁরা। প্রতিভার বারুদে ঠাসা এক একটি বিস্ফোরক যেন। কাজপাগলের এই দলটি নিমেষেই ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্পকে তুলে নিয়েছিলেন আকাশের কাছাকাছি।

চা আসে। শিল্পী নিজেই এগিয়ে দেন। বসার ঘরটায় একটা আলমারি, সেটার তিন-চতুর্থাংশ ভরে আছে নানা স্মারক-সম্মাননায়। একটি স্মারকের ওপর তাঁর বাবা চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমানের ছবি। সেসব থেকে তাঁর সংগীতজীবনের প্রাপ্তি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর মুখ থেকে জানার চেষ্টা করি সেসবের কিছুটা।

কীভাবে বন্ধুত্ব হলো সালমান শাহর সঙ্গে? ‘আমরা একে অন্যকে চিনতাম। পরিচয় বন্ধুত্বে রূপ নেয় “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” ছবির পর। ছবি মুক্তির পর পাগলের মতো ব্যস্ত হয়ে গেল সে। জন্মদিন করার টাইম কোথায়। জন্মদিন? দেখা গেল সেদিনও শুটিং করছে। আমাদের দেখা হতো এফডিসিতে। কিংবা সিম্ফনি স্টুডিওতে, গানগুলো রেকর্ড করতাম, সেখানে। বেশির ভাগ হিরো প্লেব্যাকের সময় উপস্থিত থাকত না। কিন্তু সালমান শাহ চলে আসত, জানার চেষ্টা করত। এটা তার একটা দায়িত্ববোধের পরিচয়। আগেভাগে প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারে সে খুব ভালো ছিল। তার সঙ্গে গান নিয়েই কথা হতো বেশি। কীভাবে করলে ভালো হয়, সেসব নিয়ে।’

আগুনকে সিনেমায় গান করার প্রস্তাব দেন সুরকার আলম খান। সিনেমায় গান করার প্রস্তাব পেয়ে চরম রোমাঞ্চিত হন আগুন। তখন তিনি ব্যান্ডের গান করেন, ‘সাডেন’ নামের একটি ব্যান্ডের শিল্পী। ব্যতিক্রম সেই কণ্ঠকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন আলম খান। সালমান শাহ, মৌসুমী ও আগুন—এই তিন নতুন শিল্পী মিলে সেদিন এক ইতিহাসের পরিচ্ছেদ রচনা করেন আলম খান।

নতুন সালমানের শুরুটা কেমন ছিল? ‘র‍্যাম্প মডেল ছিল সে। ভালো গান গাইত। এই লাইনে হুট করে আসেনি সে। লাইনমতোই আসতে হয়েছে। তবে বড় পর্দায় তার আবির্ভাবটা ছিল অন্য রকম। আমাদের সবার জন্যই সেটা ছিল একটা বিরাট টার্নিং পয়েন্ট। কপাল আরকি! এরপর যেটা হলো—সব শ্রদ্ধেয় মিউজিক ডিরেক্টর আমাকে ডাকতে লাগলেন। এমন কোনো গুণীজন বাদ রইলেন না, যার সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি।’

সালমান শাহর সঙ্গে আড্ডা মেরেছেন কখনো? ‘আড্ডার টাইম ছিল না সালমান শাহর। মনে পড়ে, ‘এ যুগের শাহজাহান তুমি যে আমার’ গানটি করেছিলাম যেদিন, একটা লাল পাঞ্জাবি পরে এসেছিল ও। সেদিন খানিকটা আড্ডা হলো। এত চটপটে ছিল যে দুদণ্ড কোথাও থামত না। আমরা ইস্কাটনে থাকতাম। দুজনের বাসা রাস্তার দুই পাশে। আমার বাসার সামনে দিয়েই সে তাঁর গাড়িটাকে ইউ টার্ন করাত। একদিন আমি অন্য বন্ধুদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম। দেখলাম, তার গাড়িটা সামনে থেকে ঘুরছে। গাড়ির ভেতরে বেশ জোরে জন ডেনভারের ‘কান্ট্রি রোড’ গানটা বাজছিল। আগেই বলেছি, সে নিজেও কিন্তু ভালো গান গাইত। আসলে আপাদমস্তক একটা শিল্পী ছিল ও। সে জন্যই এত সুন্দর করে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছিল।’

কথার ভেতর প্রবেশ করে বলি, ‘তারপর, আপনার গানই হয়ে গেল তাঁর গান!’ আগুন বলেন, ‘আমার কণ্ঠ তাঁর ঠোঁটে এমনভাবে ম্যাচ করে গিয়েছিল যে মনে হতো ওরই গান। সেও তেমন মনে করত যে আগুন যখন গাইছে, ওটা তার গান। ভার্সেটাইল গান করেছি আমি। ডিপজলের গানও গেয়েছি, দিলদারের গানও করেছি। সালমান, রিয়াজ, ফেরদৌস সবার গান করেছি। সালমানের সিনেমা দেখে মানুষ যখন বলেছে, এটা সালমান নিজেই গেয়েছে, নাকি আগুন? সেটা তাঁর ক্রেডিট, আমার সার্থকতা।’

সালমানের গেটআপের কথা মনে আছে? ‘ও নতুন গেটআপ নিয়ে ফিল্মে এসেছিল। তার মতো ইয়াং হিরোই তো আসেনি আগে। সালমান শাহর পরের নায়কদের গেটআপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেসব সালমানেরই গেটআপ। সে শিক্ষিত পরিবারের সন্তান, সে স্মার্ট হবে না তো কে হবে! নীলা চৌধুরীর ছেলে সে। তার আচার-ব‍্যবহার, ইংরেজি বলা সবার থেকে আলাদা। ব্র্যান্ডের জিনিস ছাড়া সে পরত না। তার সবচেয়ে সাধারণ জুতা ছিল রিবকের। এফডিসিতে তাকে আলাদা করা যেত। আর এত অ্যাকটিভ ছিল, এফডিসির গেটের পাশে সিকিউরিটিদের একজন তাকে বলল, তাঁদের টেলিভিশন নেই। পরদিনই সেখানে টেলিভিশন চলে এল। অবশ্য শাকিব খানের এখনকার গেটআপগুলো ভালো। সে একাই ইন্ডাস্ট্রিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এ রকম আরও শাকিব দরকার। ‘ওয়ান ম্যান শো’ কখনো ভালো হয় না। আবার মাত্র চার বছরে সালমান যা করে গেছে, আজীবন মানুষ সেগুলো মনে রাখবে তাকে।’

জানতে ইচ্ছে করে, তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে কী করলেন? ধাক্কাটা সামলালেন কীভাবে? ‘ইস্কাটন থেকে মগবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। রেকর্ডিং ছিল তখন। একটা ফোন এল খালাম্মার (সাবিনা ইয়াসমীন)। তিনি বললেন, তোর জন্য খুব খারাপ একটা খবর আছে। খালাম্মা প্রায়ই আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করতেন, ভয় দেখাতেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। আমি বললাম, কী হয়েছে? তিনি বললেন, সালমান কিন্তু নেই। শুনে আমি হতবাক। সব ফেলে চলে গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি সবাই এসেছে। সবাই অবাক। এ রকম যে ঘটতে পারে, ভাবাই যায় না। ঘটনাটা হজম করতে কষ্ট হয়েছিল।’

সালমানের জন্মদিনে কী করবেন আজ? ‘নাগরিক টিভিতে গাইব। এখনো কোথাও প্রোগ্রাম করতে গেলে সালমান শাহর গান ছাড়া হয় না। একদিন আমি থাকব না, সেদিনও সালমানের গান শুনবে মানুষ। বাংলাদেশ যত দিন আছে, সালমান তত দিন থাকবে।’

নায়ক সালমান শাহর আজ ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এখন যদি কোনোভাবে সালমান সামনে চলে আসে, কী বলবেন?
‘বলব, এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হয়নি।’

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

আরও লেখা

আলো ভাগাভাগি করে বাঁচি

যে কোন পরামর্শ, সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করুন