‘ছিঃ, ছোট মানুষ সিনেমা হলে যেতে নেই। বাসায় টেলিভিশন দেখ।’ মায়ের ধমক খেয়ে চুপসে যেতে হতো। মন কিন্তু পড়ে থাকত বিদ্যুতের খাম্বায় সাঁটা নতুন সিনেমার পোস্টারে। সেখানে শাবনূরের সঙ্গে সালমান শাহের দারুণ ছবি। মামারা-চাচারা আড়ালে তাঁর ভঙ্গি নকল করে ডান হাতে ঘড়ি পরে গলায় স্কার্ফের বদলে রুমাল পেঁচিয়ে রাখতেন। অন্য কেউ না বুঝুক, আমি বুঝতাম, কাকে নকল করছেন তাঁরা।
পড়তে বসলে মন চলে যেত ঘরের বাইরে। যেখানে বাসার সামনে দুলকি চালে চলে যাচ্ছে মাইক লাগানো রিকশা। তার দুই পাশে বড় বোর্ডে সিনেমার পোস্টার। মাইকে একটি ভারী কণ্ঠ মনোযোগ কাড়ে সবার— ‘হ্যাঁ ভাই, আগামীকাল চিত্রালী সিনেমায় আসিতেছে…।’ কিন্তু এই ডাক সেই ‘ছোট’ মানুষটির জন্য নয়!
সিনেমা দেখার জন্য ভরসা তখন একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন। সপ্তাহে একদিন, শুক্রবার দুপুরে একটি সিনেমা দেখানো হতো। সেগুলোর বেশির ভাগই ছিল পুরোনো সিনেমা। কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল শুভমুক্তির ওই নতুন সিনেমাটির প্রতিই। টেলিভিশনে কেন নতুন সিনেমাগুলো দেখানো হতো না, তখন তা বুঝতাম না। রীতিমতো জিদ আর কান্নাকাটি করেই ক্যাসেট আনানো হতো বাসায়। এভাবেই এক সময় ভিসিআরে সালমান শাহের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘জীবন সংসার’, সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমাগুলো দেখা হয়ে যায়। আমার ঘরও ভরে ওঠে সালমান শাহের ভিউকার্ডে।
ছবির অ্যালবামের ভেতরে রাখা সেই সব ভিউকার্ড এখনো সযত্নেই রাখা আছে। সেখানে তাঁর কত রকম ভঙ্গির ছবি। যেসব দেখে রসিকতা করে খালা বলতেন, ‘তুই মেয়েমানুষ নাকি! নায়কের ছবি জমাস কেন!’ খালাটা বোকা, বোঝেনও না। সালমানের মাথায় বাধা রুমাল, গ্লাভস পরা হাতে শক্ত করে ধরা ফাইভ স্টার পিস্তল, ডান হাতের ঘড়ি সবই আমার আকর্ষণের বস্তু। জিনিসগুলোতে অন্য কাউকে ভালো লাগে না। তাঁর উপুড় করা হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে ছুরির ফলা দিয়ে আঘাত করার স্টাইলটা প্র্যাকটিস করতে গিয়ে কতবার যে হাত কেটে ফেলেছি, মনে নেই।
এক সকালে ঘুম ভেঙে জানলাম, সব স্মার্টনেস নিয়ে নায়ক চলে গেছেন। আত্মহত্যা করেছেন তিনি। প্রচণ্ড অভিমান হয়েছিল তাঁর ওপর। এক হাতে পানপাত্র অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেটসহ স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যে ছবিটা, তাঁর দিকে তাকিয়ে ভেবেছি, তিনি কীভাবে থাকবেন নায়ককে ছাড়া?
দৈনিক পত্রিকা আর ম্যাগাজিন ঘেঁটে নায়কের মৃত্যুর খবর আর প্রতিবেদনগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। জানতে পারি, তাঁর মৃত্যু রহস্যঘেরা। নায়কের ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক শক্র থাকে।
দৈনিক পত্রিকা আর ম্যাগাজিন ঘেঁটে নায়কের মৃত্যুর খবর আর প্রতিবেদনগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। জানতে পারি, তাঁর মৃত্যু রহস্যঘেরা। নায়কের ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক শক্র থাকে। এরপর পেপার কাটিং সংগ্রহ করার শুরু। রকিব হাসানের লেখা তিন গোয়েন্দা সিরিজ পড়ার অভ্যাসের কারণে তখন যেকোনো বিষয়েই রহস্যের গন্ধ পেতাম। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর আর প্রতিবেদনগুলো পড়ে প্রায় নিশ্চিতই হয়ে গেলাম, নায়কের আত্মহত্যা আসলে হত্যা। ঠিক করলাম, বড় হয়ে এ রহস্যের জট আমিই খুলব। নায়কের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে তুলে দেব আইনের হাতে। শৈশবের যত বোকাবোকা ভাবনা!
আজ এই নায়কের ৪৪তম জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে তাঁর জনপ্রিয়তা হয়তো শাহরুখ খানের মতোই হতো। জন্মদিনের পার্টিতে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর পাখির মতো ডানা মেলা গাড়িটি নিয়ে আসতেন। দুই হাতে উড়ো চুমু ছড়িয়ে দিতেন ভক্তদের দিকে। বন্ধুদের সঙ্গে অনেক সেলফি তুলতেন। পেশার সুবাদে হয়তো দেখা হতো নায়কের সঙ্গে। কিন্তু এও মনে হয়, সালমানের এই না থাকাই হয়তো তাঁকে অমর করেছে। প্রিয় করে রেখেছে কোটি কোটি ভক্তের কাছে।