ভাত, ভাতার এবং ভাতের দোকান

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

প্রথমেই জানা যাক গল্পের নামের তরজমা ও তাফসির।

ভাত হলো সেদ্ধ চাল, যা ধান থেকে উৎপাদিত হয়। ধান হলো মাটিতে জন্মানো এক ধরণের শষ্য যেটি এক সময় বাঙলাদেশে প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো বলে রপ্তানী করা যেত। এখন আমদানি করতে হয়। ইদানীং আমদানি করতে হচ্ছে বীজ। ওসব বীজ জমির উর্বরতা নষ্ট করে। উচ্চ ফলনশীল ওই বীজে উৎপাদিত ধানের চালে যে ভাত হয়, তাতে ভাতের খাদ্য উপাদান শর্করা কম থাকে। কেউ বলেন, ‘আগে এক থালা ভাত খেলে পেট ভরে যেত। এখন পাঁচ থালা খেলেও মনে হয় ক্ষুধা যায়নি।’

চাল হয় বিভিন্ন জাতের। ইরি, আউশ, আমন, বোরো … তৃণমূল মানুষ যে চাল খান, তার সাধারণ নাম ‘মোটা চাল’, ৩৪ টাকা কেজি। হোটেলে আগে ভাতের প্লেট ছিলো ৪ টাকা এখন হয়েছে ৬-৭ টাকা, কোনো কোনো জেলায় ১০ টাকা। বাঙলাদেশে মানুষ আর দারিদ্র বাড়ায় ভাতের বদলে আলু খেতে উদ্বুদ্ধ করছেন ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী খণ্ডকালীন নতুন অভিভাবকেরা।

ভাতার শব্দটি রংপুরের বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ যার অর্থ, যে ভাত দেয় বা স্বামী। এটি ভাতের কমপারেটিভ ডিগ্রি নয়, যাকে সুপারলেটিভ—ভাতেস্ট ভাবা যেতে পারে। বগুড়া আর বরিশালের লোকেরাও শব্দটির মালিকানা দাবি করেছেন, যেটিকে তারা একটি অফেনসিভ সম্মোধন রুপে ব্যবহার করে থাকেন। উদাহরণ: ভাতারের ঘর মাগির ভালো লাগে না।

ভাতের দোকান হলো জনসাধারণের খাবার জন্য বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় ভাত রান্না ও বিক্রি করার জায়গা। এর সাথে তরকারিও বিক্রি করা হয়, কিন্তু একে তরকারির দোকান না বলে ভাতের দোকান বলা হয়। কারণ জনগণ তরকারি দিয়ে ভাত খায়, ভাত দিয়ে তরকারি খায় না। কোনো কিছু দিয়ে কোনো কিছু খাওয়া মানে যেটি খাওয়া হয় তার পরিমাণ থাকে বেশি, আর যা-দিয়ে খাওয়া হয় তার পরিমাণ থাকে কম। যেমন: লবন দিয়ে কুল/বরই খাওয়া।

নীলা ভাতারের তোয়াক্কা না করে ভাত খাবার জন্য সোজা ভাতের দোকানে এসে একাই বসে পড়েছে। যাঁর তোয়াক্কা না করে এসেছে তাঁকে আবার ভাতার বলাও মুশকিল। সে আসলে নীলার কে বা কী? পাঠককে বিবেচনার সুযোগ দিয়ে গল্পটি এগিয়ে যাবে।

নীলা টেবিলে গিয়ে বসা মাত্র তার সামনে ধোঁয়া ওঠা এক প্লেট ভাত চলে আসলো। ভাত একা একা আসেনি। ওয়েইটার দিয়ে গেছে। ওয়েইটারের নাম টুলটুল ভাই। তার গালে গালের মূল মাংস ছাড়াও একটা ছোট্ট আলুর মতো এক খাবলা এক্সট্রা মাংস আছে। সে নীলাকে বলেছে, তাঁর মাংসের এই দলাটা তার বউয়ের খুব পছন্দের জিনিশ। বউ ব্যাপারটা শুনতে যদিও নীলার হাসি লাগে; কারণ বউ শব্দটির অর্থ তার কাছে খুব একটা স্পষ্ট না। গত ২৭ বছরে শব্দটির অর্থ যতটুকু সে উদ্ধার করতে পেরেছে তা হলো, বউ ধারণাটি হলো পারমানেন্ট রক্ষিতা/যৌন সঙ্গী; এ ছাড়া আর কিছুই নয়।

নীলার সাথে যে লোকটা থাকে (রুমমেট বলা যেতে পারে) তার সাথে নীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পড়ালেখা করেছে। লোকটা যখন ছেলেটা ছিল তখন তার সাথে নীলার পরিচয় ঘটে। ফাস্ট ইয়ারের দিনগুলো তার ছিলো গন্ধরাজের সুবাসের মতো। সেই সুবাসের একটা অংশের নাম শোভন। পরিচয়ে প্রথম দিনই শোভন রাত একটায় ফোন করে শান্ত স্বরে তাকে বলেছিলো নতুন একটা কবিতা সে পড়েছে যা তার অসাধারণ মনে হয়েছে এবং সে এখনই তার সাথে সেটা শেয়ার করতে চায়। হতবাক নীলা কিছু বলে ওঠার আগেই ভরাট কণ্ঠে ছেলেটা আবৃত্তি করতে থাকে…

তোমাকে বলবো বলে
তারকাটা. পাথুরে জলের হিম,মৃত্যু. রক্ত. লাশ.
এই ধংশের শ্মশান ডিঙিয়ে এলাম তোমাকে বলবো বলে
পাঁজরে পুষ্পের ঘ্রান জ্ব’লে আছে ক্ষুধার মতোন,
ক্ষুধাতো বেঁচে থাকার অন্য নাম
তোমার আমার দূরত্বের মাঝে সেই ক্ষুধার পাথর
তুমি তাকে প্রেম বলো, স্বপ্ন বলো, লোকে বলে মলিন বিরহ
তোমাকে বলবো বলে জলকষ্ট, নিদ্রাহীন রাত
মানুষের শ্বাপদ-স্বভাব মাখা লোভাতুর দাঁতের কৌশল
আমি তৃষ্ণার অপূর্ন ওষ্ঠ থুয়ে এসেছি পেছনে
জীবনের তিন ভাগ অনাহার নিয়ে একটি জঠরে
যে মানুষ পাঁজরে পুষ্পের ঘ্রান পুষে রাখে প্রেমের মতোন
আমি তার স্বপ্নের শিয়র থেকে উঠে এখানে এসেছি
তোমাকে বলবো বলে
তোমাকে বলবো বলে কষ্ট. ধংশ. ক্ষয়. লেলিহান ক্রোধ
তামাটে মাটির গন্ধ বুকে এই ধ্বংসের
কবর ডিঙিয়ে এলাম
শুধু তোমাকে বলবো বোলে,
ভালোবাসা প্রিয়মুখ তোমাকে বোলে।

নীলা আবারো কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাইনটা কেটে যায় আর তার মগজে নাগরদোলার মতো দুলতে থাকে ‘‘তোমাকে বলবো বোলে, ভালোবাসা প্রিয়মুখ, তোমাকে বলবো বলে” তোমাকে বলবো বলে তোমাকে বলবো বলে তোমাকে বলবো বলে তোমাকে বলবো বলে।

কী বলবে তাতো কবিতায় কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও যায়নি; কবিতাটি যে আবৃত্তি করলো সেও আজ পর্যন্ত বলেনি। তার পরের দিনগুলোতে ক্যাম্পাসে তারা বিল্টইন হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে আর কখন যে কতকিছু হয়ে যায় ভাষাহীন, কেউ কোনোদিনও বুঝে উঠতে পারেনি। লেখা পড়া শেষ হয়ে গেলেও ওরা বুঝে উঠতে পারেনি তারা কীভাবে কি করবে বা কী তাদের করা উচিৎ। বুঝে উঠতে না পারা ওরা মিরপুরে বাসা ভাড়া করে বসবাস এবং সহবাস করা শুরু করে আর পাশাপাশি করে দুজন দুটো চাকরি। সারাদিন অফিসের পর দুজনে আড্ডা দিতে থাকলো দিনের পর দিন ঠিক ছাত্রজীবনে বন্ধুদের সাথে যেভাবে দিতো। তাদের আড্ডার জায়গাগুলোতে তাদের নতুন পুরোনো মিলে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবও তৈরি হলো।

ক্যাম্পাসের সেই নীলা আর শোভন বন্ধুই রয়ে গেল; অন্য কিছু আর তাদের হওয়াই হলো না। অথবা তারা কেউ কোনো দিন কারো কিছুই হয়নি বা হতে চায়নি। কোনোদিনতো কেউ কাওকে প্রেম নিবেদন করেনি, বন্ধুত্বের কোনো শর্ত বা চুক্তিতে তারা আবদ্ধ হয়নি। তাদের যৌথ জীবন বিবর্তনহীনভাবে একই রকম রয়ে গেছে; যেখানে তার বন্ধুদের কোলের শিশুরা হাঁটতে দৌড়াতে ছবি আঁকতে অ আ লিখতে শিখে ফেলেছে, কারো কারো শিশুরা পাঁচ সাতটা ইংরেজী ছড়াও মুখস্ত করে ফেলেছে। তাদের ভেতরে শিশুর ছোট্ট হাত পা ছাপ ফেলে না। যান্ত্রিক নাগরিক জীবনে তারা রোবোটিক জীবন যাপন করে, রাতে নিশ্চুপ হয়ে পাশাপাশি বসে শেয়ারে কেনা বিশ ইঞ্চি রঙিন টিভিটা দেখে, প্রতিদিনের মতো কেউ কারো চাহিদার ধার না ধেরে বহুবছরের না ঘুমানো মানুষের মতো ঘুমিয়ে পড়ে। একটা সময় তাদের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের মতো একটা টান যে একসময় ছিলো সেটিও স্মৃতি হয়ে যায়, তারা ভুলে যায় স্বাভাবিক বৈধ নিয়মের বাইরে তাদের একটা চমৎকার বোঝাপরা ছিলো যেটি এখন রুপ নিয়েছে দুর্বদ্ধোতায়। তাদের যৌন জীবনের তৃপ্তি-তৃষ্ণা শূণ্যতায় রূপায়িত হয়। তাদের নিয়ম মাফিক ঘুম ভাঙা-তৈরি হয়ে একসাথে কাজে বেরিয়ে যাওয়া- একসাথে লাঞ্চ করা-কাজ শেষে একত্র হয়ে আড্ডায় চা গেলা-বাসায় ফিরে এক সাথে রেঁধে খাওয়া-চরম পুলকিত রাত্রি যাপন— সব রূটিনে বিতৃষ্ণা তৈরি হলো যা নীলাকে পীড়া দিতে শুরু করলো। শোভন অন্য কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে কি না তা নিয়েও তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। নিজের বলে যে জায়গাটুকু শোভনের ভেতরে তার জন্য থাকার কথা ছিলো সেটুকুতে চর জেগেছে বলেই নীলা একলাই চলে এসেছে এখানে। দিনের পর দিন কে খেলো বা খেলো না, কার শরীর খারাপ কি না, গভীর রাতে কার পরানে টান জাগলো কি না এসবের তোয়াক্কা না করা কয়েকটা মাস যখন বছরে গিয়ে ঠেকলো তখনই নীলার মনে হলো কী আর হবে এই অর্থহীন যৌথজীবনের? একা একা থাকাইতো ভালো। আবার ভাবে সবাইকেই এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। সবারই একটা সময় হয়তো এ অনুভূতি হয় ‘কী হয়ে গেল’! যাদের সন্তান নামক সেতু তৈরি হয় তাদের আর কিছু করার থাকে না। তারা এক অসম্পূর্ণ বিরক্তিকর অতুষ্ট জীবন যাপন করতে করতে একটা সময় ফুরিয়ে যায়। সামনে রাখা গরম ভাতের ভেতর হাত চালাতে চালাতে নীলা ভাবতে থাকে, এই শাদা দানাগুলোর জন্য এতো কিছু!? আসলে কি এতটুকুই সব! নীলা বিশ্বাস করতে চাইলো না। একজন মানুষের বেঁচে থাকা থেকে মরে যাওয়া পর্যন্ত কী কী প্রয়োজন? খাবার! একজন কথা বলার মানুষ! অনুভূতি-ষ্পর্শ বিনিময়ের একজন সঙ্গী! স্নেহের জন্য একজন মা! বটগাছের মতো ছাঁয়ার জন্য বাবা। একটা ঘর! কোনো একটা বাদ পড়লে কী হয়? কোনো কোনো মানুষের কোনো কোনোটিতো আলাদা আলাদা করে বাদ পড়ে যায়। তারা কীভাবে বেঁচে থাকে? যাদের স্বামী মারা যায় সেই মেয়েগুলো কীভাবে বেঁচে থাকে? তাদের মন আর শরীরের তৃষ্ণা কি তাদের স্বামীর সাথে সাথে মরে যায়? শোভন কি পারতো না তাকে একটা সন্তানের সেতু তৈরি করে দিতে? তাহলে কি সম্পর্কটা এরকম হতো? প্রশ্নগুলো মগজে আর ভাতগুলো তরকারিতে মাখাতে মাখাতে নীলা চোখের পানি ধরে রাখেনি বলে তার এক ফোটা গিয়ে পড়লো তার থালার শাদা দানাগুলোর ভেতরে।

( আমাদের শহরে একগাড়ি সামসু ২০০৯ )

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

আরও লেখা

আলো ভাগাভাগি করে বাঁচি

যে কোন পরামর্শ, সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করুন