ভয়ে জড়ো সরো হয়ে বিছানায় বসে ছিলাম । ডায়েরিটা বের করে চট করে লিখেছি, ‘একটা অচেনা লোককে বিয়ে করেছি’ এবং দ্রুত সেটা বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলেছি। সারা গা থরথর করে কাঁপছিল।
নিজেকে প্রশ্ন করেছি, ‘কী করা উচিৎ?’
‘কুমারীর অভিনয়?’
‘যদি বুঝে ফেলে? কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলবো নাকি? যদি রেগে যায়?’
খট করে দরজাটা খুলে গেল আর আমার হৃৎপিণ্ড লাফ দিয়ে গলার কাছে উঠে এল । জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। গলা শুকিয়ে আসছিল। মাথা নিচু করে শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম লোকটা দাঁড়িয়ে গেল।
‘গৌরি’, খুব শান্ত স্বরে আমার নাম ধরে ডাকলেন তিনি । আমি তাকানোর সাহস পেলাম না।
‘গৌরি, আমি পাশের ঘরে ঘুমোতে গেলাম’, বললেন তিনি ।
“স্বামী যদি তোমার সঙ্গে ঘুমোতে না চায়, তুমি একজন ব্যর্থ স্ত্রী”, মায়ের কথাটা মাথার ভেতরে বেজে উঠল । তবু আমি তাকালাম না, চুপ থাকলাম।
‘জানতে চাইলে না কেন?’, রসিকতাচ্ছলে বললেন তিনি । যেন আমাকে কথা বলিয়েই ছাড়বেন। আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে ফেললাম।
‘তুমি আমার স্ত্রী … পতিতা নও ।’
মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না বলে, তাঁর কথা বুঝলাম না। “যখন বুঝবে না যে স্বামীকে কী বলা উচিৎ, তখন চুপ থেকো”, বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল। আমি তাই করলাম।
‘কেউ কাউকে চিনিই না যখন, একসঙ্গে ঘুমালে পতিতার সঙ্গে শোয়া ছাড়া একে আর কী বলবে? যেদিন দুজনের মনে হবে যে একসঙ্গে ঘুমানো উচিৎ, সেদিনই একসঙ্গে ঘুমাব । সেদিনই না হয় স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হব। অচেনা কোনো মেয়ের সঙ্গে সেক্স করতে চাই না।’
তিনি বাতি নিভিয়ে চলে গেলেন। খানিক পর ফিরে এসে বাতি জ্বাললেন। মজা করে বললেন, ‘আবার যেন ভেবো না আমি সমকামী। হলফ করে বলছি আমি কিন্তু তা না।’
ভয়ে থরকম্প, তবু ফিক করে হেসে ফেলেছিলাম। তিনিও মুচকি হেসে বাতি নিভিয়ে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। আমি তখনো হাসছিলাম। মেক আপ, বিয়ের শাড়ি না ছেড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেদিন। চোখে ভিজে উঠেছিল।
মানুষ নাকি সুখের সময়ও কাঁদে। কথাটার কোনো মানে হয়? আমার কাছে হয়। যখন খুব গভীরভাবে কোনো কিছু অনুভব করা হয়, তখন নিজের ভেতরের একটা জিনিসকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আমার তেমনটাই হয়েছে। আমার কাছে আনন্দ-অশ্রু আরও অর্থবহ।
ঘুম থেকে উঠে নাশতা তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। রান্না ঘরে গিয়ে দেখি তিনি খাবার তৈরি করছেন। জানি না, ব্যাপারটায় আমাকে কতটা ভীত দেখাচ্ছিল যে, আমাকে দেখে তিনিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। দৌড়ে কাছে এসে বলেছিলেন, ‘গৌরি, তুমি ঠিক আছ তো?’ তাঁর কণ্ঠে উদ্বেগ।
নিচু স্বরে বলেছিলাম, ‘আপনি রান্নাঘরে কেন?’
মনে হলো তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। পরে বুঝলেন আমি কী বলতে চেয়েছি।
‘শোনো গৌরি, আমি রাঁধতে পছন্দ করি, বুঝেছ? যখন মন চাইবে তুমি রাঁধবে, আমার মন চাইলে আমি ।’ অধিকারের স্বরে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি আমার চাকর নও, স্ত্রী।’
“তোমার স্বামীকে যদি রান্নাঘরে যেতে হয়, স্ত্রী হিসেবে তুমি ব্যর্থ”, মায়ের কথাটা মনে করতে করতে রান্নাঘর থেকে সেদিন বেরিয়ে এলাম ।
ধীরে ধীরে তাঁর সঙ্গে সহজ হতে চেষ্টা করলাম। খুব গোপন কিছু শেয়ার করা বা সাবেক প্রেমিকের ব্যাপারে কিছু বলিনি। তবে কথা বলতে শুরু করলাম। একবার নিজের অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপারে তিনি আমার মতামত জানতে চাইলে আমার চোয়াল ঝুলে পড়েছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, বাবাও মায়ের কাছে এভাবেই জানতে চাইতেন। মা কিছু বললেই বাবা ক্ষেপে যেতেন। একবার আমার সামনেই মাকে থাপ্পড় মেরে বসেছিলেন। আমাকে একবার কঠিন স্বরে বলেছিলেন, “স্বামী তাঁর কর্মক্ষেত্র নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা মানে তোমার কাছে পরামর্শ চাইছে, তেমন ভেবো না। মুখটা বন্ধ রেখো।” এখানে আসার পর বুঝলাম, তিনি ঠিক বলেননি। আমি পরামর্শ দিতে শুরু করেছিলাম এবং তিনি শুনেছেন। বাড়িতে প্রচুর কান্নাকাটি করতাম আমি, এখানেও তাই। কিন্তু দুই জায়গার কান্নার অনুভূতি একেবারে ভিন্ন।
আমার আত্মবিশ্বাস তৈরি হলো। ভাবতেই পারিনি যে, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা তাঁকে বলার সাহস পাব। একবার বলেছিলাম, ‘আমি কি ফ্রেন্ডদের নিয়ে একটু বেড়াতে যেতে পারি? মাত্র দুই রাতের জন্য? উল্টাপাল্টা কিচ্ছু করব না, যত দ্রুত সম্ভব ফিরব।’
মা একবার ধর্মীয় এক অনুষ্ঠানে তাঁর ফ্রেন্ডদের সঙ্গে বাইরে যেতে চাইলে বাবার চাহনির কথা আমার মনে আছে। আমার স্বামীও তাই করলেন।
তিনি আমার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকালেন, ভীষণ রেগে গেলেন। এই প্রথম খোলাখুলি তাঁকে কিছু বলেছি। কিন্তু বুঝিনি, মন খুলে কথা বলতে সংকোচ করতে নেই।
হতাশ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘গৌরি, কতবার বলব যে তুমি আমার স্ত্রী। এভাবে কেন আমার অনুমতি নিতে আসো! তুমি কি কয়েদি নাকি? সবকিছু কেন জিজ্ঞেস করতে হবে? জানিয়ে চলে যাও। অনুমতি নিয়ে যাওয়ার কি আছে?’ এই বলে গটগট করে চলে গেলেন তিনি।
মা-বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, বড় করে তুলেছেন। কিন্তু এবার আমি বাঁচতে শুরু করলাম। আমার স্বামী আমাকে বাঁচতে শেখালেন।
আমি তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমিও নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি তো শিখছি। প্লিজ একটু ধৈর্য ধরেন।’ সম্ভবত মন খুলে সেটাই আমার প্রথম কিছু বলা। বলেছিলাম, ‘কি করলে ব্যর্থ হব এমন হাজারটা কাজের তালিকা দিয়েছে মা, আর কোন কোন ক্ষেত্রে মুখ বন্ধ রাখতে হবে সেরকম হাজারখানেক মুহূর্তের তালিকা দিয়েছেন বাবা। বুঝতেই পারছ, আমাকে শিখতে হচ্ছে।’
আমি মজা করিনি, কিন্তু তিনি হাসলেন। বললেন, ‘হাসার জন্য আর আগের ব্যবহারের জন্য মাফ করে দিয়ো। তোমার কথাগুলো আমার মনে থাকবে, যদি তুমি মনে রাখো যে, তুমি আর তোমার বাড়িতে নেই। অতীতকে পেছনে ফেলে রাখো গৌরি।’
তিনি এক সেকেন্ডের জন্য খুব ভদ্রভাবে আমার পিঠে হাত রাখলেন, এই বাড়িতে ঢোকার পর প্রথম আমাকে স্পর্শ করলেন তিনি। সত্যি বলতে, সেটা ছিল আমার কাছে “অন্যরকম” আর সেসময় যখন তিনি আমার নাম ধরে ডাকলেন, সেটাও অন্যরকম শোনাচ্ছিল।
আমি বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত দিতে শুরু করলাম। আমাদের জন্য আনা মদ খেতাম সবাই মিলে। আমি বাঁচতে শুরু করেছিলাম। আমাকে জন্ম দেওয়া আমার মা-বাবার সব থেকে বড় উপহার নয়, তাঁদের সব থেকে বড় উপহার ছিল আমাকে একজন সম্পূর্ণ অচেনা লোকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া।
এক রাতে আমরা দুজনে মদ খাচ্ছিলাম। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কী হতে চাই। আমি প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠেছিলাম, লেখক হতে চাই।
শুনে তাঁর অভিব্যক্তি হয়েছিল দেখার মতো, যা আমি কখনোই ভুলব না। আমি আগে তাঁকে কখনো এত খুশি হতে দেখিনি। বাজি ধরে বলতে পারি তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। তিনিও এক সময় লেখক হতে চেয়েছিলেন।
“যদিও আমাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়, কিন্তু আমরা দুজনে মিলে কি লিখতে পারব?’, আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত স্বরে মুচকি হেসে তিনি জানতে চেয়েছিলেন ।
আমি শুধু কাঁধ নেড়েছিলাম।
ওই রাতের মতো আমি আর কখনো কাঁদিনি। কান্নার শব্দ ঠেকাতে মুখে বালিশ চেপে ধরতে হয়েছিল। জানি না কেন এত কেঁদেছি সেদিন। কিন্তু আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। দেখলাম দরজার ওপাশে একটা কালো ছায়া। তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিলেন।
আমি কাছে গিয়ে তাঁকে চুমু খেলাম। জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। টেনে বিছানায় নিয়ে ফেললাম।
তিনি বললেন, ‘তুমি নিশ্চিত যে, এসব অ্যালকোহলের প্রভাব না?’
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, ‘তুমি নিশ্চিত যে, তুমি সমকামী না?’
তিনি হাসলেন, আমাকে বিছানায় চেপে ধরে বিবস্ত্র করতে করতে বললেন, তুমিই যাচাই করো।
এসব আমার কাছে নতুন নয়। মনে হলো, ব্যাপারটা তাঁকে বলা দরকার। আমি তাঁকে থামালাম। বললাম, ‘আগে একটা কথা বলে নিই; আমি কিন্তু কুমারী নই।
তিনি আমার শরীর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। বললেন, ‘আমি তো ভাবলাম তুমি বলবা যে, তোমার এইডস আছে।’
আমি হেসে তাঁকে কাছে টেনে চুমু খেতে শুরু করলাম। আমরা মিলেছিলাম। বিয়ের সাড়ে তিন মাস পর আমরা মিলিত হয়েছিলাম।
মনে করে নিই, হ্যাঁ বিয়ের সাড়ে তিন মাস পরই আমরা মিলিত হয়েছিলাম এবং তিনি ছিলেন স্বাভাবিক। পরদিন ঘুম ভেঙে দেখি তিনি প্রশান্তি নিয়ে আমার পাশেই ঘুমোচ্ছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে আমি ডায়েরিটা বের করে ওই পাতায় গেলাম, যেখানে নীল কালিতে লিখেছিলাম ‘একটা অচেনা লোককে বিয়ে করেছি’। এবার কালো কলমে সেখানে লিখলাম, ‘এবং আমি তাঁর প্রেমে পড়েছি, কারণ আমি সত্যিই গভীরভাবে তাঁর প্রেমে পরেছি। হাসলাম আর সিদ্ধান্ত নিলাম, যে প্রতিজ্ঞা আমি তাঁর কাছে করেছি, সেটা রাখব। আমি লিখব, সে ব্যাপারে নিশ্চিতই ছিলাম। কিন্তু জানতাম না যে কি লিখব। এখন জানি। আমি আমাদের কথাই লিখব।
ইংরেজি মূল গল্প : তেনজিন চেঢা